বাগদাদে মার্কিন হামলায় ইরানি কমান্ডার নিহত

মধ্যপ্রাচ্যে চরম উত্তেজনা : যুদ্ধের দামামা : বেড়েছে তেলের দাম
মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ড্রোন হামলায় ইরানের বিশেষ বাহিনী ‘রেভ্যুলিশনারি গার্ড’র কুদস শাখার প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানিসহ আটজন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার বাহিনীটির পক্ষ থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়। হামলায় ‘পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটস’ (পিএমইউ) সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবু মাহদি আল-মুহানদিসও নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ভয়ংকর প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে ইরান। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে পেন্টাগন নিশ্চিত করেছে। বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে আগুন দেয়ার দুই দিনের মাথায় মার্কিন বাহিনী এই পদক্ষেপ নিলো। দূতাবাসে হামলার ঘটনায় ইরানকে দুষছে ওয়াশিংটন। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বে তেলের দামও বেড়ে গেছে চার শতাংশ। ইরানের আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধির প্রধান কারিগর জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। তিনি ইরানের বিপ্লবী বাহিনীর সবচেয়ে প্রভাবশালী কমান্ডার। সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গত অক্টোবরেও তাকে হত্যাচেষ্টা বানচাল করে দেয়ার দাবি করেছিলো ইরান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে শুক্রবার ভোরে ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়। প্রথমদিকে রকেট হামলার কথা বলা হলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুক্রবার ভোরে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোলেইমানিকে হত্যায় ড্রোন থেকে হামলা করা হয়। বাগদাদ বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালের কাছে দুটো গাড়িতে ছোড়া তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এর মধ্যে একটি গাড়িতে ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি ও মিলিশিয়া নেতা আল-মুহান্দিস। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য ইরাকের প্যারামিলিটারি ফোর্সের সদস্যরা ছিলেন দ্বিতীয় গাড়িতে। ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ঘাঁটিতে মার্কিন হামলায় ২৫ জন নিহত হওয়ার পর বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুরের দুই দিনের মাথায় এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দেবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ইরানের অভিজাত বাহিনী আইআরজিসির কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল সোলেইমানি এক হামলায় নিহত হয়েছেন। পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন বাহিনী বিদেশে তাদের সদস্যদের সুরক্ষার স্বার্থে ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে’ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছে। বলা হয়েছে, ‘ইরানের ভবিষ্যৎ হামলা পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়ায় ছিলো এই আক্রমণের উদ্দেশ্য। বিশ্বের যেখানেই আমাদের নাগরিক ও সম্পদ রয়েছে, তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নেবে।’
এদিকে, জেনারেল সোলেইমানি নিহত হওয়ার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার একটি ছবি টুইট করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পরও এ ঘটনার জের ধরে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে আলোচনায় বসার জন্য ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘ইরান এ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেনি। এমনকি আলোচনার কোনো সুযোগও তারা হারায়নি।’ তবে সোলেইমানি হত্যার পর প্রতিশোধের হুংকার ছেড়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, ‘বিশ্বের কুচক্রী ও শয়তান রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরে একনিষ্ঠ ও বীরোচিত জিহাদ চালিয়ে গেছেন সোলেইমানি। যে অপরাধীরা তাদের নোংরা হাত দিয়ে গত রাতে জেনারেল সোলেইমানির রক্ত ঝরিয়েছে, তাদের জন্য ভয়ংকর প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে।’ ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে জেনারেল কাসেম সোলেইমানি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে দেয়া হতো জাতীয় বীরের সম্মান। তার কুদস ফোর্স কাজ করে মূলত বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর ‘ফরেইন উইং’ হিসেবে। এই বাহিনী জবাবদিহি করে সরাসরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে। সোলেইমানি একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশলী হিসেবে তৈরি হয়েছেন। ইরাক ও সিরিয়ায় ক্ষমতা নির্ণয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের উপস্থিতি সুসংহত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। জেনারেল সোলেইমানি বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুরের পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে পেন্টাগন দাবি করে আসছে, যদিও ওই হামলার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে ইরান। ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানপন্থি মিলিশিয়াদের ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান হামলার প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। ভবনের অভ্যর্থনা কক্ষে আগুন দিয়ে তারা দূতাবাসের বাইরে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। দুই দিন ধরে দূতাবাস কর্মীদের অবরুদ্ধ করে রাখার পর শিয়া মিলিশিয়া নেতাদের নির্দেশে বুধবার সরে যায় তারা। দূতাবাসে হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, এজন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে। অভিযোগ অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিও।
তেলের দাম বেড়েছে চার শতাংশ: বাগদাদে জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহতের পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে চার শতাংশের বেশি। মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহে বিঘœ ঘটার আশঙ্কায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তেলের বাজারে মূল্য-সূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। ফলে এখন তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ৬৯ ডলার ১৬ সেন্ট। গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের সরকারি তেল স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর তেলের দাম এটিই সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট’ (ডব্লিউটিআই) অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়িয়েছে এক ডলার ৭৬ সেন্ট বা দুই দশমিক ৯ শতাংশ। এতে তেলের দাম পৌঁছেছে ৬২ ডলার ৯৪ সেন্ট। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেনা কমান্ডারদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সম্পদ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এলাকায় পাল্টা হামলা চালানো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জন তিরমান বলেন, ‘বিভিন্ন উপায়ে যে ইরান এর প্রতিশোধ নেবে, তা নিশ্চিত। এর আগে আমরা তাদের মুখোমুখি না হয়েও প্রতিশোধ নিতে দেখেছি। তারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হবে না, তেহরান সম্ভবত সৌদি তেল ট্যাংকার বা তেল শোধনাগারে হামলা চালাবে।’ তিরমান আরও বলেন, ‘মূল বিষয় হচ্ছে, ইরান স্বরূপে ফিরবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সম্পদে হামলা চালাবে। তারা অতীতে যা করেছে, আবারও সেটির পুনরাবৃত্তি করবে। তবে আমার মনে বড় প্রশ্ন জাগছে, এর মাধ্যমে আমরা কি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সংঘাত যুগে প্রবেশ করছি?’ আন্তর্জাতিক তেল বেচাকেনা সংস্থা ওয়ান্ডার বিশ্লেষক এডওয়ার্ড ময়া বলেন, ‘হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে তেল সরবরাহের ঝুঁকি বাড়বে। আমরা দেখছি, ইরাকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ এর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। ওই সময় হামলার দায় স্বীকার করে ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি বিদ্রোহীরা। তবে যুক্তরাষ্ট্র এজন্য ইরানকে দায়ী করে।