চলচ্চিত্র আমার গানের প্রধান জায়গা: সাবিনা ইয়াসমিন  

বিনোদন ডেস্ক: সাবিনা ইয়াসমিন। নন্দিত কণ্ঠশিল্পী। অনিন্দ্য কণ্ঠ আর অনবদ্য গায়কিতে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে যাচ্ছেন তিনি। সেই সঙ্গে ‘পুত্র’ ছবির জন্য তিনি এ বছর সেরা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন। এ নিয়ে ১৪ বার পাওয়া এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা হয় তার সঙ্গে-

আপনাকে অভিনন্দন ‘পুত্র’ ছবির ‘মান অভিমান ভুলে’ গানের জন্য সেরা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ায়। আপনার অনুভূতি জানতে চাই…

স্বীকৃতি সব সময় আনন্দের। শিল্পীজীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছি। এ নিয়ে আলাদা কোনো মোহ নেই। তারপরও যখন কোনো স্বীকৃতি পাই, মনে হয়, আমার কাছে শ্রোতাদের প্রত্যাশা এখনও শেষ হয়নি। তাদের জন্য আরও গাইতে হবে। গানে গানে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ।

পাঁচ দশকে ১৬ সহস্রাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পেয়েছেন ১৪টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ নানান সম্মাননা। এর পরও শিল্পীজীবনে কোনো অপ্রাপ্তি আছে বলে মনে হয়?

গানের প্রতি ভালোবাসা ছিল। তাই দিনমান গান করে গেছি। গান গেয়ে কী পাব, কী হারাব- তা নিয়ে কখনও ভাবিনি। মায়ের অনুপ্রেরণা আর বোনদের গান গাইতে দেখে ছোটবেলায় গানে তালিম নেওয়া শুরু করেছিলাম। গান করতে করতেই কোথা দিয়ে যে এতটি বছর কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি! আমার যত অর্জন সব সংগীতকে ঘিরে। পাঁচ দশক অনেক দীর্ঘ সময়। অথচ ভাবলে অবাক লাগে, গানে গানে এত বছর কাটিয়ে দিয়েছি! স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অগণিত মানুষের ভালোবাসাই আমাকে এগিয়ে চলার শক্তি জুগিয়েছে। এই ভালোবাসা আমার শিল্পীজীবনের সবচেয়ে দামি পুরস্কার।

পেছন ফিরে তাকালে পেরিয়ে আসা সময়গুলো কি স্বপ্নের মতো মনে হয়?

 

অতীত স্বপ্ন আর কল্পনাতেই ধরা দেয় সব সময়। কারণ যা ফেলে এসেছি, তা নতুন করে পাওয়ার উপায় নেই। এ জন্য মাঝেমধ্যে স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে যাই। চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভেসে ওঠে সেই দিনগুলোর কথা, যখন বোনদের সঙ্গে দেখাদেখি গান গাওয়া শুরু করেছিলাম। শৈশবে প্রথম মঞ্চে ওঠা, বেতার-টিভিতে গান গাওয়া। এর পর চলচ্চিত্রে কত যে গান গেয়েছি, তার সঠিক হিসাব-নিকাশ নিজেরও জানা নেই। এসব কিছুর মাঝে মা হওয়া, ক্যান্সারকে জয় করে ফিরে আসা, দুস্থ শিশুদের পাশে দাঁড়ানো, শিল্পীদের মেধাস্বত্ব নিয়ে আন্দোলন- আরও কত ঘটনা যে মনের পর্দায় চলচ্চিত্রের মতো ভেসে ওঠে, তা বলে শেষ করা যাবে না! আমার ধারণা, শুধু আমি নই; কম-বেশি সব মানুষই পেছনের দিনগুলো নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে।

সংগীত ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্রে বেশি গান গেয়েছেন। চলচ্চিত্রকে এতটা প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী?

আজকের সাবিনা ইয়াসমিন হয়ে ওঠার মূল চালিকাশক্তি হলো চলচ্চিত্র। ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে প্লেব্যাকের মধ্য দিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তার আগে শিশুশিল্পী হিসেবে টিভি ও স্টেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে বুঝতে পেরেছি, চলচ্চিত্র আমার গানের প্রধান জায়গা। সেখান থেকেই আমার কণ্ঠ ছড়িয়ে দিতে হবে নানা দিকে। সে ভাবনা থেকেই দিনরাত একাকার করে প্লেব্যাক করে গেছি। শিশুদের লিপে যেমন গান করেছি, তেমনি নায়িকা ও অন্যান্য চরিত্রের ঠোঁটেও আমার কণ্ঠ তুলে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে, সব ধরনের চরিত্রের জন্য আমার কণ্ঠ কোনো না কোনো ছবির জন্য রেকর্ড করা হচ্ছে। দর্শক-শ্রোতাও সেসব গান শুনে ভালো লাগার কথা প্রকাশ করেছেন। আর সবকিছুর আগে শ্রোতার ভালো লাগাই হলো মুখ্য। যে জন্য আমিও চলচ্চিত্রের বাইরে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখিনি। বেতার-টিভি, অ্যালবামের জন্য গান করলেও চলচ্চিত্রকেই প্রাধান্য দিয়েছি।

অনেকে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করতেন। কিন্তু আপনি অ্যালবাম প্রকাশ শুরু করেছিলেন আশির দশকে। এতটা সময় নেওয়ার কারণ কী?

চলচ্চিত্রে নিয়মিত গাইছি বলেই অ্যালবাম নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। কিন্তু প্রকাশকদের অনুরোধে শেষমেশ বেশ কিছু অ্যালবাম প্রকাশ করেছি। গান করতে গিয়ে অনেকের সহযোগিতাও পেয়েছি। তাই অ্যালবাম নিয়ে তেমন কোনো অনীহা ছিল না। আশির দশক থেকে আধুনিক গানের অ্যালবাম করা শুরু করেছিলাম। তারও আগে ৭০-এর দশকে একটি রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করেছি।

শিল্পীদের মেধাস্বত্ব আদায় নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এখনও কি তা অব্যাহত আছে?

শিল্পী ও সংগীত স্রষ্টারা বঞ্চনার স্বীকার হলে আওয়াজ উঠবেই। সেটা সাংগঠনিক বা একক- যেভাবেই হোক, তা থেমে থাকবে না। জানি না, আমাদের দেশেই কেন মেধাস্বত্বের জন্য আন্দোলনে নামতে হচ্ছে! আমরা যারা শিল্পী, সুরকার, গীতিকবি- এক কথায় যারা গানের মানুষ; তারা কেবল অবহেলার শিকার হচ্ছি। কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই ছিল। যে কারণে আমরা সংগঠিত হয়ে গঠন করেছিলাম ‘বাংলাদেশ লিরিসিস্ট, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফরমার্স সোসাইটি’ [বিএলসিপিএস]। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে মাঠেও নেমেছিলাম। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে পরবর্তী উদ্যোগ সেভাবে জোরালো হয়ে ওঠেনি। তাই বলে বঞ্চিত মানুষেরা সব সময় চুপ থাকবে- এটাও ভাবার কোনো কারণ নেই।

নতুন প্রজন্মের জন্য পুরোনো গানের সংকলন প্রকাশের কথা বলেছিলেন। সে সংকলনের জন্য গান সংগ্রহ এখনও চলছে কি?

বেশ কিছু গান সংগ্রহ করেছি। সংকলন না করে আলাদাভাবে কিছু গান প্রকাশও করেছি। পুরোনো গানগুলো সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। অনেক সময় নিয়ে এটা করতে হয়। তারপরও নানা ব্যস্ততার মাঝে গান সংগ্রহ চলছে। আসলে এটা করছি নতুন প্রজন্মের যারা ৬০-৭০ এর দশকের গানের সঙ্গে পরিচিত নয়, তাদের কথা ভেবে। তাদের অনেকেই জানে না, সংগীতে সে সময়ের গানগুলো কতটা সমৃদ্ধ ছিল।

অভিজ্ঞদের পাশাপাশি তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। এ সময়ের তরুণ সংগীত পরিচালকদের কতটা সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে?

তরুণদের অনেকে ভালো কাজ করছে। কে সম্ভাবনাময়, তা কাজ না করলে তো জানার উপায় নেই। সংগীত নিয়ে এখন যারা নিয়মিত কাজ করছে, তাদের চিন্তাভাবনা, কাজের ধরন কেমন- এটাও যাচাই করে দেখা দরকার। তবে এটা ঠিক যে, অনেকে তারকাখ্যাতির মোহে গান করছে। তাদের এই মোহ ত্যাগ করতে হবে। কারণ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শিল্পী বড় হয়; বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কাউকে শিল্পী বানায় না। সংগীত সাধনা করেই শিল্পীসত্তাকে সমৃদ্ধ করতে হয়।

গানের পাশাপাশি অসহায় শিশুদের জন্য কাজ করেছেন…

কিছু কাজ আছে, যা মানবিক বোধ থেকে করতে হয়। ‘ডিসট্রেস চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্ট-এর প্যাট্রন হিসেবে এবার দুস্থ শিশুদের সাহায্যার্থে কাজ করেছি। আগামীতেও অসহায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব। কারণ সবকিছুর পর এটাই সত্যি- আমার মানুষ। তাই মানুষ হিসেবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াব; এটাই স্বাভাবিক।