হলি আর্টিজানে হামলায় ৭ আসামির মৃত্যুদণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার: তিন বছর আগে ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় ২২ জনকে হত্যার দায়ে নব্যজেএমবির সাত সদস্যের ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যারশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন এ সময় কাঠগড়াতেই উপস্থিত ছিলেন। রায় শুনে তাদের কারও চেহারাতেই অনুশোচনার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। তাদের একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহু আকবর, আমরা কোনো অন্যায় করিনি।’একটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ- দেয়া হয়। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড। বিচারক তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্যদিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মুত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সাত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদ- কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয় রায়ে। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আরেক আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেয়া হয়েছে রায়ে। তাকে রায় শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।

জানা যায়, কেবল মাদরাসাপড়–য়া গরিব ঘরের ছেলেরা নয়, নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও বাড়ি পালিয়ে নিরুদ্দেশ হচ্ছে; জড়াচ্ছে জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, বাংলাদেশ তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস’র দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকা- ঘটায়।

‘নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যায়, তখনই আকস্মিকভাবে তাদের ওপর নেমে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা শিশুদের সামনে এ হতাকা- চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা নিথর দেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হলি আর্টিজান বেকারি।

‘কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়।;

সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় সাত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক রায়ে বলেন, তাতে ‘ভাগ্যহত মানুষের স্বজনেরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।’

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এর ৬(২)(অ) ধারার অভিযোগ থেকে আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, ৭ ধারার অভিযোগ থেকে মামুনুর রশিদ রিপন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১০, ১১, ১২, ১৩ ধারার অভিযোগ থেকে আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত।

রায়ে বিচারক দ-িত আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন এবং মৃত্যুদ- কার্যকরের অনুমতির জন্য রায় ও মামলার নথিত হাই কোর্ট বিভাগে পাঠাতে বলেন।

আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা মনে করি সাক্ষ্যগুলো ডাউটলেস না। অনেক কন্ট্রাডিকশন আছে, অনেক ইনকসিসটেন্সি আছে, লেক অব কোলাবেরশন আছে। আমরা এ নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করব।’

নিয়ম অনুযায়ী ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এই রায় প্রকাশের সাত দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন দ-িত আসামিরা। এক আসামির খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও আপিল করার সুযোগ পাবে।

সাত জঙ্গির ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। একজনের খালাসের বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করে যদি মনে করি, আপিল করা যাবে।’

হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে সেদিন দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন, যাদের একজন বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খান।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তার ভাই রাজিউদ্দিন খান রাজু বলেন, ‘আমরা সব জঙ্গির ফাঁসি চেয়েছিলাম, তাই হয়েছে। একজন খালাস পেয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন সেই জঙ্গি হামলায় দেশের ভাবমূর্তি যতোটুকু ম্লান হয়েছিলো, মৃত্যুদ-ের রায়ের মধ্যদিয়ে তা পুনরুদ্ধার হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সারা বিশ্বকে প্রমাণ করতে পেরেছি যে, বাংলাদেশ এ রকম হত্যাকা- হলে তার বিচার অত্যন্ত দ্রুত হয় ও সঠিক বিচার আইনি সকল সব প্রক্রিয়া ফলো করে বিচার সম্পন্ন করা হয়।