হলি আর্টিজান মামলার রায়

নব্য জেএমবির ৭ সদস্যের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়ে বহুল আলোচিত রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ ও নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার রায় ঘোষণা করেছে আদালত। বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। তবে অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্তরা সবাই আদালতে উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রায় শোনার পরও এদের চেহারায় অনুশোচনার চিহ্ন ছিল না। এমনকি এদের একজন উচ্চস্বরে বলেছেন ‘আলস্নাহু আকবর, আমরা কোনো অন্যায় করিনি।’ বলাই বাহুল্য, বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করে। সঙ্গত কারণে এই রায়ের দিকেই দেশের জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। আদালতের রায়ে জঙ্গিদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় দেশের জনগণও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
তথ্য অনুযায়ী, গুলশান-২ এর হলি আর্টিজান বেকারিতে বিদেশিদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল। এ ছাড়া শিথিল নিরাপত্তার কারণে ওই রেস্তোরাঁকে জঙ্গিরা হামলার জন্য বেছে নেয় বলেও তদন্তে উঠে আসে। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করানো। যে কারণে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকে নৃশংসতা শুরু করে। জবাই ও গুলি করে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম হয়; তখনও অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে জিম্মি হয়ে ছিলেন। রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান ‘থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করলে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হন। জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয় ১৩ জনকে। অপরদিকে ভয়াবহ ওই হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযান চলাকালে এবং পরে হাসপাতালে মারা যান হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী।
ঘটনার পরদিনই গুলশান থানায় মামলা হয়। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন। এ ঘটনায় ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত আটজনকেই কেবল আসামি করা হয়। আদালতে ৬ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্য প্রদান শুরু হয়ে চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর তা শেষ হয়। আর রায়ের তারিখ ঘোষিত হয় ২৬ নভেম্বর। তদন্তে উঠে আসে, হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া; বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার বিষয়গুলো উঠে আসে। এরপর দুই বছরে হামলায় জড়িত আরও অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ মামলার তদন্তে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
উলেস্নখ্য যে, হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ ওই হামলার পর কেবল মাদ্রাসাপড়ুয়া গরিব ঘরের ছেলেরাই নয়, নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও বাড়ি থেকে পালিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে জঙ্গিবাদের মতো ভয়ঙ্কর পথে জড়ানোর তথ্যও সামনে আসে। এ ছাড়া নজিরবিহীন ওই ঘটনার পর দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জঙ্গিবাদ রুখে দিতে সরকারের হাত শক্তিশালী করতে রাস্তায় নামে। সরকার তথা প্রশাসনও জঙ্গিবাদ দমনে আরও কঠোর হয়। তাই এই হামলার রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। এ রায় প্রমাণ করে, অন্যায় করলে তার সাজা পেতেই হয়।
দেশবিরোধী জঙ্গি চক্রের মূলোৎপাটনই জনগণ প্রত্যাশা করে। ফলে এ রায় কার্যকরের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। পাশাপাশি, রায়কে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্তকতাও ছিল প্রশংসনীয়। আমরা মনে করি, এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে দেশের কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার উদ্ভব হলে তাও কঠোর হাতে দমন করতে হবে। দেশ থেকে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনই সবাই প্রত্যাশা করে।