অতীতের সব দামের রেকর্ড ভেঙে পেঁয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি

একদিনেই বেড়েছে কেজিতে ৫০-৬০ টাকা : সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ-ড. গোলাম রহমান
স্টাফ রিপোর্টার: পেঁয়াজের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে বৃহস্পতিবার। একদিনেই ‘পাগলা ঘোড়ার গতিতে’ বেড়েছে এর দাম। দিনশেষে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজির দাম সর্বোচ্চ ২২০ টাকায় উঠেছে। যা দিনের শুরুতে ছিলো ১৬০-১৭০ টাকা। পাইকারি বাজারগুলোতে সরবরাহ নেই- এমন তথ্য ছড়িয়ে দিলে খুচরা বাজারে প্রতি কেজির দাম গড়ে ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দিনের শেষে দেশি পেঁয়াজ ২০০-২২০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ১৮০-২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এর আগে কখনও পেঁয়াজের দাম এমন অস্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ নেই বললেই চলে। সে জন্য খুচরা বাজারেও এর ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে এর দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রভাব পড়েছে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও।
এদিকে সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। চাহিদার তুলনায় আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বাজারে বলতে গেলে পেঁয়াজ নেই। তবে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ও সুপারশপগুলোতে যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শিতা, পরিকল্পনা ও তদারকির অভাবেই বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হলেও তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এছাড়া মাঠ প্রশাসন থেকে কোনো ব্যবস্থা নিলে সেগুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে নেয়া হয়েছে বিপরীতমুখী ব্যবস্থা। ফলে বাজারে এর দামে কোনো নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়নি।
এদিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মোবাইল টিম’ রাজধানীর শ্যামবাজারের পেঁয়াজের আড়তে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করায় ও অধিক মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করায় নিউ বাণিজ্যালয়কে ২০ হাজার টাকা, মেসার্স বাণিজ্যালয়কে ২০ হাজার, সিকদার অ্যান্ড সন্সকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে। তবে পাইকারি বাজারে সরবরাহ কম থাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কম।
অভিযান শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মোবাইল টিমের সদস্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার ম-ল বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে তারা অধিক মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করেছে। এ ছাড়া তারা মূল্যতালিকা প্রদর্শন করেনি। যে কারণে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের পাইকারি বাজারে মোবাইল টিম অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দেন। এতে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের সঙ্কট দেখা দেয়।
বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পেঁয়াজ আমদানিকারকদের আমদানি শুল্ক শূন্য করে দেয়ার আহ্বান জানান। আর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে ঝাঁজ বেশি হয়ে যাচ্ছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরও তৎপর হওয়া উচিত।
এর আগে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ুন বলেন, শিগগির পেঁয়াজের মূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। উপজেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন লিন সিজন (পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হওয়ার আগমুহূর্ত) চলছে। এ সময় একটা সংকট থাকে। আমাদের নতুন পেঁয়াজ এখনও ওঠেনি। কিছুদিনের মধ্যে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভারত থেকেও আমদানি চালু হয়েছে। পেঁয়াজের বাজার যেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলো, সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু আছে, কোথাও কেউ যেন বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে।
গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে পণ্যটির দাম বেড়েই চলেছে। সরকার কোনোভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি লাগাম ধরে রাখতে পারছে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২০০-২২০ টাকা দরে।
বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিসর থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৬০-১৭০ টাকা। যা একদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৩৫ টাকা। মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা। যা একদিন আগে বুধবার বিক্রি হয় ১৪০ টাকা। এ ছাড়া দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০০-২২০ টাকা। যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ১৬০-১৭০ টাকা।
সূত্র জানায়, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১৫-১৬ লাখ টন। বাকি ৮-৯ লাখ টন আমদানি করা হয়। কিন্তু চাহিদার বাইরেও সরবরাহ লাইনে থাকে আরও ৬-৭ লাখ টন। ফলে দেশে বছরে পেঁয়াজের দরকার হয় ৩০-৩১ লাখ টন। উৎপাদনের বাইরে গত অর্থবছরে ১২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এ হিসাবে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। ভারতে দাম বাড়ানোর আগেই যেসব পেঁয়াজ দেশে এসেছে সেগুলো এখনও রয়ে গেছে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে কম দামে। কেননা তারা পেঁয়াজের দাম বাড়ায়নি। গত জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে গড়ে ২০-২২ টাকা কেজি দরে। ভারতে বন্যার কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেড়ে যায়। ফলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তারা পেঁয়াজ রফতানিমূল্য প্রতি টনের দাম ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার করে। এতে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়তে থাকে। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে এর দাম আরও বেড়ে ১২০ টাকায় ওঠে। পরে এর আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে দাম কিছুটা কমে। এখন আবার সরবরাহ সংকটের কারণে এর দাম হুহু করে বাড়তে থাকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। সরকার বলেছিল দেশের বড় ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ আমদানি করতে। সেটা মিডিয়ায় ঢালাওভাবে প্রচারও হয়েছে। কিন্তু ওনারা কি উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটা জানা বড় জরুরি। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারকে সহায়তা করছে না। তবে সরকার যদি নিজ উদ্যোগে আমদানি করত, তাহলে আজ পেঁয়াজের দর নিয়ে এ অবস্থায় আসত না। সরকার ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের সহায়তা দিলেও ব্যবসায়ীরা সরকারকে সহায়তা করেছে তার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখছি না। এ সব ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের বাজারেও ২শ টাকা ছাড়িয়েছে প্রতি কেজি পেঁয়াজের পাইকারী দাম। খুচরা পর্যায়ে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মাঝে পেঁয়াজ কেনায় অনিহা দেখা দিয়েছে। ফলে এক প্রকার পেঁয়াজ শূন্য অবস্থা বিরাজ করছে মেহেরপুর জেলার পাইকারী ও খুচরা বাজারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মেহেরপুর জেলার কয়েকটি বাজারের খোঁজা নিয়ে পেঁয়াজের এক প্রকার শূন্যতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে পাইকারী ব্যবসায়ীদের আড়তে পেঁয়াজ মজুদ নেই। আগে যেখানে অন্ততপক্ষে এক সপ্তাহের মেয়াদ মজুদ থাকতো। খুচরা বাজারেও একই অবস্থা। ক্রেতা পর্যায়ে চাহিদা কমে যাওয়ায় খুচরা বিক্রেতারা সামান্য পরিমাণ পেঁয়াজ রেখেই কেনাবেচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেলার সবচেয়ে বড় মরিচ-পেঁয়াজ আড়ৎ গাংনী কাঁচা বাজারের পাইকার ব্যবসায়ী সাহাদুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ১৮০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পাইকারী বাজারগুলোতে দু’শো টাকায় কিনতে হচ্ছে। কুষ্টিয়ার রাজারহাট ও সোনাপুর বাজার থেকে মূলত মেহেরপুর জেলায় পেঁয়াজ আসে। আজ সেখানে আকাশচুম্বি দর ও চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের আমদানীও কম। অস্থীতিশীল দরের কারনে পেঁয়াজ কিনবো কিনা তা নিয়ে সংশয় কাটছে না।
একই বাজারের আড়তদার বাবুল আক্তার বলেন, চাষিদের ঘরের পেঁয়াজ অনেক আগেই ফুরিয়েছে। দর্শনা, বেনাপোল ও হিলি স্থলবন্দর থেকে ভারতীয় এলসি পেঁয়াজ আসছে না। অপরদিকে মিয়ানমার থেকে আমদানী করা পেঁয়াজে পানির পরিমাণ বেশি। স্বাদ নেই তাই ভোক্তা পর্যায়ে অনিহা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পেঁয়াজ জোগাড় করার বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছেও পেঁয়াজের তেমন চাহিদা নেই।
বিভিন্ন বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, ক্রেতারা এসে একশো গ্রাম দু’শো গ্রাম পেঁয়াজ কিনছেন। এক কেজি বার তারও অধিক পেঁয়াজ ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। তাই আমরাও ৫/১০ কেজি পেঁয়াজ কিনে বিক্রি করছি। আগের মতো ১০/১৫ মণ পেঁয়াজ কিনে এনে বিক্রি করা হচ্ছে না।