স্টাফ রিপোর্টার: পুরান ঢাকার তিন আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের এক কর্মচারীর বাসার সিন্দুক থেকে ৫ কোটি টাকা জব্দ করেছে র্যাব। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে ৭৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার (যার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা) ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র। তবে অভিযুক্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত ছিল।
যাদের বাসায় অভিযান চালানো হয় তারা হলেন : পুরান ঢাকার ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হারুনুর রশিদ, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক ভূঁইয়া ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তার ভাই রূপন ভূঁইয়া এবং এনামুলের কর্মচারী স্থানীয় যুবলীগ কর্মী আবুল কালাম আজাদ। র্যাব জানিয়েছে, এসব টাকা ক্যাসিনো থেকে আয় করা হয়েছে। আর টাকা রাখতে সমস্যা হওয়ায় তা দিয়ে সোনা কিনে রাখা হয়। যেভাবে অভিযান : জানা গেছে, সোমবার মধ্যরাতের পর সূত্রাপুরে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়ার বাসা (৩১ নম্বর বানিয়ানগর) ঘিরে ফেলে র্যাব। মঙ্গলবার সকালে বাসাটিতে অভিযান চালিয়ে তিনটি সিন্দুকের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে সেখান থেকে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা ও সাড়ে আট কেজি (৭৩০ ভরি) স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়।
দুপুরের পর একই থানার নারিন্দায় হারুনুর রশিদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। তার বাড়ির দ্বিতীয় তলায় একটি সিন্দুক থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা জব্দ করা হয়। একই সময় র্যাবের অপর একটি দল এনামুলের বিশ্বস্ত কর্মচারী যুবলীগ কর্মী আবুল কালাম আজাদের লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাসায় অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে একটি সিন্দুক থেকে উদ্ধার করে আরো ২ কোটি টাকা। তবে অভিযানকালে র্যাব কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
র্যাবের ব্রিফিং :অভিযান চলাকালে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আজ (গতকাল) পরিচালিত তিনটি অভিযানে মোট ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, টাকাগুলো অবৈধ ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রথম অভিযানে আমরা পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করি। দ্বিতীয় অভিযানে একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, নারিন্দার শরত্গুপ্ত রোডের ২২/১ নম্বর বাড়ির তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হকের বন্ধু হারুন অর রশিদ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি সেখানেও একটি সিন্দুক আছে। যেখানে অবৈধ টাকা রাখা আছে। তিনি বলেন, হারুনের বাসায় প্রবেশ করে আমরা দেখতে পাই, খাট ও ওয়ারড্রবের মাঝামাঝি একটি ভল্ট। সেখান থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ সময় এনামুলের বন্ধু হারুন বাসায় ছিলেন না। সে স্থানীয় ট্রাকস্ট্যান্ডের কর্মচারী। হারুনের স্ত্রী জানান, তারা এ অর্থের বিষয়ে কিছুই জানেন না। কয়েক দিন আগে এনামুল এসে টাকাগুলো বাসায় রেখে যান।
র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এনামুল সপ্তাহখানেক আগে থাইল্যান্ডে চলে গেছেন। রূপন দেশেই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। গেন্ডারিয়ায় বিভিন্ন এলাকার দেওয়ালে দেওয়ালে দুই ভাইয়ের ছবিসহ পোস্টারও দেখা গেছে। তাদের আটক করতেই অভিযান চালানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এনামুল ও রূপনরা ছয় ভাই। ১৯৮৫ সাল থেকেই এনামুল ওয়ান্ডার্স ক্লাব ও রূপন আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলেন। কিন্তু গত তিন-চার বছর আগে তারা হঠাত্ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি কেনা শুরু করেন। এনামুলদের যে বাড়িটিতে র্যাব অভিযান চালাচ্ছে সে বাড়িটি দেড় বছর আগে হারুনুর রশীদ নামে একজনের কাছ থেকে তারা কিনেছেন। ভবনের চতুর্থ তলায় এনামুলের শ্যালক-শাশুড়ি থাকেন। র্যাব সূত্র জানায়, এই চতুর্থ তলার সিন্দুক থেকেই ৭৩০ ভরি স্বর্ণ পাওয়া গেছে। আরেকটি সিন্দুক থেকে এক কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, ওয়ারী, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, বংশাল, কোতোয়ালি থানা এলাকায় এ পরিবারের ৫০টির মতো বাড়ি রয়েছে। তবে রূপন ও এনামুল কোন বাড়িতে থাকে সেটি তারা জানেন না।
এনামুলের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী শিলা রহমান জানিয়েছেন, তার স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা এনামুলের বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইটের তদারকি করেন। গত রবিবার এনামুলের বডিগার্ড পাভেল এসে একটি ব্যাগ ও সিন্দুকটি রেখে যায়। পাভেল যেভাবে দিয়ে গিয়েছিল, সেভাবেই ঐ ব্যাগ আলমারিতে তুলে রাখা হয়েছিল। আমরা খুলেও দেখিনি। আজ ওখান থেকেই পিস্তল বের করেছে র্যাব।
সিন্দুকগুলো কেনা হয় কয়েকদিন আগে : অভিযানে যে পাঁচটি সিন্দুক পাওয়া গেছে তার সবগুলোই নতুন। সিন্দুকের ওপর দোকানের নাম লেখা স্টিকার জ্বলজ্বল করছিল। সবগুলোই কেনা হয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের মালিটোলা বিপণি বিতানের শাবনাজ স্টিল কিং নামের একটি দোকান থেকে।
এ ব্যাপারে শাহনাজ স্টিল কিংয়ের ম্যানেজার আবুল বাশার জানিয়েছেন, দুই জন লোক শনিবার সকালে ৭৮ হাজার টাকায় ঐ সিন্দুকগুলো কেনেন। তারা সিন্দুকগুলো দেখে দাম জিজ্ঞাসা করেন এবং দাম বলার সঙ্গে সঙ্গে দরদাম না করেই দ্রুত টাকা পরিশোধ করে দেন। তিনি বলেন, ঐ দুই জনকে তিনি চেনেন না। মোট চারটি রশিদে তারা টাকা পরিশোধ করেন। রশিদে ক্রেতার নাম ও মোবাইল নম্বর লিখতে চাইলে তারা বলেন, এসব লাগবে না। ৬টাকা পরিশোধ করার পর দুই জনের একজন আগে চলে যায়। অন্যজন লেবারদের সঙ্গে ভ্যানগাড়িতে সিন্দুকগুলো নিয়ে যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল বাশার বলেন, একসঙ্গে পাঁচটি সিন্দুক কিনেছে, এরকম আর কারো কথা তিনি মনে করতে পারেন না। র্যাবের দুই জন সদস্য এসেছিল দোকানে। তারা ঐ সিন্দুক কেনা নিয়ে কিছু তথ্য নিয়ে গেছে। তারপর সেই লেবারদের সঙ্গে নিয়ে গেছে বাসা চেনার জন্য।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তত্ত্বাবধানে ‘৬০টি ক্যাসিনো চালানোর’ খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ চারটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, কয়েক লাখ টাকা ও মদ উদ্ধার করে র্যাব। পরে অভিযান চালানো হয় আরো কয়েকটি ক্লাবে। এর অংশ হিসেবেই পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।