নীতিমালার গ্যাঁড়াকলে এমপিও ক্ষুব্ধ অপেক্ষমাণ শিক্ষকরা : তালিকায় এখনও চলছে ঘষামাজা

কতগুলো স্কুল-কলেজ মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও পাবে তা নিয়েও টানাপোড়েন আছে
স্টাফ রিপোর্টার: নীতিমালায় নানা অসঙ্গতির গ্যাঁড়াকলে ফের আটকে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির কার্যক্রম। এতে বহুল আলোচিত এমপিওভুক্তির তালিকার প্রজ্ঞাপন সহসা জারি হচ্ছে না। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব আয়োজন শেষ হলেও নীতিমালায় নানা অসঙ্গতির কারণে প্রতিষ্ঠানের তালিকা চূড়ান্ত করা নিয়ে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা অনুমোদনের জন্য শীর্ষ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে পাঠানোর পর তা দফায় দফায় ফেরত আসছে এবং সংশোধন হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা এখনো ঘষামাজা চলছে। তালিকায় কতগুলো স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থান পাবে তা নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের এমপিও দেয়ার আগে ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আনা হচ্ছে। এতে এমপিওভুক্তির কার্যক্রম লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেছে। তা এ সরকারের শেষ পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে বলে মনে করেন তারা। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তাতেই বড় ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। এতে সংক্ষুদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন। তারা অসঙ্গতি দূর করার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। মন্ত্রণালয় তা গ্রহণ করে যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। এতে প্রায় চূড়ান্ত হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওর ঘোষণা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নীতিমালায় যেসব অসঙ্গতি: ২০১৮ সালের এমপিও নীতিমালার আলোকে এমপিও দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই আলোকেই প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা হিসেবে চারটি ক্যাটাগরিতে ১০০ নম্বর নির্ধারণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানের বয়স ২৫, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ এবং পাসের হারে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০ নম্বরের গ্রেডিং করা হয়। এই গ্রেডিংয়ের ওপর ভিত্তি করেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি ফিটলিস্ট তৈরি করে। সেখানেই গ্রেডিং এখন বড় ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।
নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬ষ্ঠ-৮ম, ৯ম-১০ম, ১১শ’-১২শ’ এবং ১৩শ’-১৫শ’ এ চারটি স্তরে ভাগ করা হলেও ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ও ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে আলাদাভাবে নির্ধারিত ন্যূনতম শিক্ষার্থী থাকলেও প্রতিটি স্তর ও বিভাগে আলাদাভাবে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারিত করায় গ্রেডিং সঠিক হয়নি বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। এছাড়া এ চারটি স্তরের তিনটি বিভাগের (কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান) জন্য আলাদাভাবে ন্যূনতম শিক্ষার্থী নির্ধারণ করা থাকলেও প্রতিটি স্তরে আলাদাভাবে প্রতিটি বিভাগভিত্তিক ন্যূনতম কত পরীক্ষার্থী থাকতে হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি। এতে নীতিমালার ধারা-১৪ (গ্রেডিং)-এ যে ২৫ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে তা সর্বস্তরে সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়নি। কারণ ন্যূনতম পরীক্ষার্থীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গ্রেডিংয়ে সর্বশেষ ধাপের ২৫ নম্বর দেয়া হয়। যেমন ন্যূনতম পরীক্ষার্থীর জন্য ১৫ নম্বর, পরবর্তী ১০ ভাগ পরীক্ষার্থী বাড়ার জন্য ৫ নম্বর এবং পরবর্তী ১০ ভাগ পরীক্ষার্থী বাড়ার জন্য ৫ নম্বর বাড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে। যদি ন্যূনতম পরীক্ষার্থীই সঠিকভাবে নির্ধারিত না হয় তাহলে গ্রেডিংয়ে শেষ ধাপে ফলাফলের শতকরা হারের ওপর ভিত্তি করে ২৫ নম্বর কীভাবে দেয়া হলো? গ্রেডিংয়ের শেষ তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের (ন্যূনতম পরীক্ষার্থী ও ফলাফলের) গ্রেডিং ৫০ নম্বর মূল্যায়নও সঠিক হয়নি বলে মনে করেন তারা।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানের স্তর ভিত্তিতে রয়েছে নানা অসঙ্গতি, যেমন ৬ষ্ঠ-৮ম এ তিনটি শ্রেণিতে ন্যূনতম শিক্ষার্থী শহর-২০০ জন মফস্বল-১৫০ জন। কিন্তু এ স্তরে ন্যূনতম কতজন পরীক্ষার্থী থাকতে হবে তা আলাদাভাবে বলা নেই। একইভাবে ৯ম-১০ম এ দুই শ্রেণিতেও ন্যূনতম শিক্ষার্থী, ন্যূনতম পরীক্ষার্থী এবং বিভাগভিত্তিক আলাদাভাবে ন্যূনতম কতজন পরীক্ষার্থী তা নির্ধারণ করা হয়নি। ১১শ’-১২শ’ এ দুই শ্রেণিতে নীতিমালায় নির্ধারিত ন্যূনতম শিক্ষার্থী শহর-২০০ জন, মফস্বল-১৫০ জন; কিন্তু নির্ধারিত ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নেই এবং বিভাগভিত্তিক আলাদভাবে নির্ধারিত করা ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নেই। ১৩শ’-১৫শ’ স্নাতক এ তিন শ্রেণিতে নির্ধারিত ন্যূনতম শিক্ষার্থী শহর-৫০ জন এবং মফস্বল ৫০ জন। কিন্তু পূথকভাবে শুধু ১৩শ’-১৫শ’ তিন শ্রেণির জন্য নির্ধারিত করা ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নেই এবং বিভাগভিত্তিক পৃথকভাবে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করা হয়নি। আছে ১১শ’-১৫শ’ পাঁচটি শ্রেণির ন্যূনতম পরীক্ষার্থী ৪০ জন। একাদশ-দ্বাদশ দুটি শ্রেণির ন্যূনতম পরীক্ষার্থী কতজন এবং ১৩শ’-১৫শ’ তিনটি শ্রেণি ন্যূনতম পরীক্ষার্থী কতজন তা পৃথকভাবে এবং বিভাগভিত্তিক পৃথকভাবে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করা হয়নি।
এসব অসঙ্গতির মধ্যে বিভাগভিত্তিক শিক্ষার্থী নির্ধারণ না করায় সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে বলে মনে করেন এমপিও সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরের বিভাগভিত্তিক ন্যূনতম শিক্ষার্থী নির্ধারিত থাকলেও (প্রতি বিভাগে ন্যূনতম শিক্ষার্থী ২৫ জন, নীতিমালা ধারা-৬, ২, ১) বিভাগভিত্তিক প্রতিটি বিভাগে পৃথক পৃথকভাবে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারিত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের গ্রেডিং মূল্যায়ন সঠিক হয়নি।
গংশ্লিষ্টরা জানান, নীতিমালায় বড় একটি অসঙ্গতি ধরা পড়েছে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিকে দুই স্তরে দেখানো নিয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে (৬ষ্ঠ-১২শ’) ৭টি শ্রেণি পরিশিষ্ট ‘খ’-তে বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে ন্যূনতম শিক্ষার্থী নির্ধারণ করা হয়েছে শহরে ৪৫০ জন, মফস্বলে ৩৫০ জন এবং পরিশিষ্ট ‘গ’-তে একই উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে ৭টি শ্রেণি কলেজ ক্যাটাগরিতে নিয়ে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী শহরে-৬০ ও মফস্বলে-৪০ নির্ধারণ করেছেন। যা স্ববিরোধী। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ স্তরে ২০১২ সালের নীতিমালায় ন্যূনতম শিক্ষার্থী শহরে-২০০ জন, মফস্বলে-১৫০ জন ও ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করা হয় শহরে-৫০ জন ও মফস্বলে-৩০ জন এবং পরে ২০১৮ সালের নীতিমালায় (১১শ’-১২শ’) স্তরে শুধু ন্যূনতম শিক্ষার্থী শহরে ২০০, মফস্বলে ১৫০ জন রাখা হয় এবং একই (২০১৮) নীতিমালায় (১১শ’-১২শ’) একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিদ্বয়ের ন্যূনতম পরীক্ষার্থীর বিধানটি বাদ দেয়া হয় এ স্তরের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। অভিযোগকারীরা বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিগুলোতে ন্যূনতম পরীক্ষার্থীর বিধানটি না থাকায় এ স্তরের (১১শ’-১২শ’) প্রতিষ্ঠানের গ্রেডিং হলো কীভাবে।
তারা জানান, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে এমপিওভুক্তি না হলে ডিগ্রি স্তর (১৩শ’-১৫শ’) তিন শ্রেণির অধিভুক্ত দেয়া হয় না। ডিগ্রি কলেজের জন্য (১৩শ’-১৫শ’) শ্রেণিগুলোতে ডিগ্রি স্তর এমপিওভুক্তির জন্য শুধু ডিগ্রি স্তর (১৩শ’-১৫শ’) শ্রেণিগুলোর জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ন্যূনতম শিক্ষার্থী ৫০ জনের আনুপাতিক হারে প্রতিটি বিভাগভিত্তিক পৃথকভাবে শুধু ডিগ্রি স্তরের জন্য ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করা সঠিক ছিলো। শুধু ডিগ্রি স্তর (১৩শ’-১৫শ’) শ্রেণিগুলোতে ন্যূনতম শিক্ষার্থী ৫০ জন নীতিমালায় থাকলেও শুধু (১৩শ’-১৫শ’) ডিগ্রি স্তরের বিভাগভিত্তিক প্রতিটি বিভাগে (কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের জন্য) পৃথকভাবে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী না থাকায় শুধু ডিগ্রি স্তরের গ্রেডিং মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। অথচ একই মন্ত্রণালয়ের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন স্তরের প্রতিটি স্তরে ও প্রতিটি ট্রেডে পৃথকভাবে ন্যূনতম শিক্ষার্থী ও ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করে সঠিক গ্রেডিং করা হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চার স্তরের প্রতিটি স্তরে পৃথকভাবে ন্যূনতম শিক্ষার্থী ও প্রতিটি স্তরে পৃথক পৃথকভাবে ন্যূনতম পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করে গ্রেডিং করায় সঠিক ও ন্যায্য গ্রেডিং করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও এমপিও বাচাই কমিটির প্রধান জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘নীতিমালায় কিছু টাইপিং ভুল এবং অসঙ্গতি আছে সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। তিনি বলেন, স্নাতক পর্যায়ে আলাদা কোনো জনবল কাঠামো না থাকায় শিক্ষার্থীর মতো পরীক্ষার্থীর ক্যাটাগরিতে স্নাতকের জন্য আলাদা পরীক্ষার্থী নির্ধারণ করা যায়নি। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু স্নাতক পর্যায়ে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করছেন, তারা কেবল স্নাতকের শিক্ষার্থীর সংখ্যাটাই দিয়েছেন বলে তিনি জানেন এবং সে আলোকেই গ্রেডিং করা হয়েছে।’ এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলেও দাবি করেন তিনি।