স্টাফ রিপোর্টার: ঝড় বৃষ্টির মরসুম শুরু হতে না হতে জনমনে এবারও বজ্রপাত নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ভারতের দক্ষিণ অঞ্চল অন্ধ্র প্রদশে গত মঙ্গলবার একদিনেই মাত্র ১৩ ঘণ্টায় ৩৬ হাজার ৭শ ৪৯টি বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে অবশ্য প্রাণহানি হয়েছে শিশুসহ ৭ জনের। এদিকে আমাদের দেশেও বজ্রপাতের ঝুঁকি দিনদিন বেড়েই চলেছে বলে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বাতলে জনসচেতনতার উদ্যোগ দরকার বলে মন্তব্য করেছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতনতামূলক একটি লেখা তিনি তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বজ্রপাতের কম্পাঙ্ক লক্ষণযোগ্য হারে বৃদ্ধি করছে। দেশেও এ মরসুমে বজ্রপাতের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিবছরই বজ্রপাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ২০১০ থেকে রাখা হিসাব বজ্রপাতে ক্রমান্বয়ে বেশি মানুষের মুত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে। ২০১৫ সালে সারাদেশে ৯৯ জনের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত করা হয়। গত সাত বছরে এই হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ৩৫১ আর গত বছর মৃত্যু হয় ২৬২ জনের। এই হিসাব কেবল সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের নির্ঘণ্ট। প্রকৃত অবস্থা হয়তো আরও ভয়াবহ।
অপরদিকে সারা ভারতে ২০০৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রধান পাঁচটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির একটা হিসাবে বলছে, দাবদাহ, সাইক্লোন, বন্যা আর ভূমিকম্পের চেয়ে বজ্রপাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল (সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া), চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা ও যশোরের বিল অঞ্চল আর উত্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর অঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। আর গত বছর প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষই মারা যান মাঠে অথবা জলাধারে (নদী, খাল, বিল) কাজ করার সময়। এসব অঞ্চলে মোবাইলফোনের টাউয়ার লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়। মোবাইলফোন কোম্পানিগুলো তাদের করপোরেট দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। পল্লী বিদ্যুৎ ও সীমান্তরক্ষীদের সব স্থাপনায় কমবেশি এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গায় গতবছর বৃষ্টি মরসুমে বজ্রপাতে মারা গেছে ৭ জন। আহত হয়েছিলেন ১৮ জন।
বজ্রপাত নিয়ে গবেষকরা বলেছেন, বজ্রপাত হওয়ার আগ মুহূর্তে কয়েকটি লক্ষণে কোথায় তা পড়বে তা বোঝা যেতে পারে। যেমন বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল খাড়া হয়ে যাবে, ত্বক শিরশির করবে বা বিদ্যুৎ অনুভূত হবে। এ সময় আশপাশের ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। অনেকেই এ পরিস্থিতিতে ‘ক্রি ক্রি’শব্দ পাওয়ার কথা জানান। আপনি যদি এমন পরিস্থিতি অনুভব করতে পারেন তাহলে বজ্রপাত হবে এমন প্রস্তুতি নিন। ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নেয়াই সুরক্ষার কাজ হবে। কোথাও বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেয়া যাবে না। যেমন- খোলা স্থানে বিচ্ছিন্ন একটি যাত্রী ছাউনি, তালগাছ বা বড় গাছ ইত্যাদি। বজ্রপাতের সময় ঘরের জানালার কাছাকাছি থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতর থাকতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরা যাবে না। বজ্রপাতের আভাস পেলে প্লাগ খুলে বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া যে পারে। গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোনো স্থানে যাওয়া যাবে না। যে স্থানে নিজেই ভৌগলিক সীমার সবকিছুর ওপরে। মানে আপনিই সবচেয়ে উঁচু। এ সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যেতে হবে। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু কোনো স্থানে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে যেতে হবে। বজ্রপাতের সময় নদী, জলাশয় বা জলাবদ্ধ স্থান থেকে সরে যেতে হবে। পানি বিদ্যুৎ পরিবাহী তাই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। বজ্রপাতে সময় কয়েকজন জড়ো হওয়া অবস্থায় থাকা যাবে না। ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যেতে হবে। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যাওয়া যেতে পারে। যদি বজ্রপাত হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে চোখ বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু এ সময় মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না। মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতো সবচেয়ে নিরাপদ। বজ্রপাত থেকে বাড়ি নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলভাবে স্থাপিত রড বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। বজ্রপাতে আহত কাউকে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতোই চিকিৎসা করতে হবে। দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে। হাসপাতালে নিতে হবে। একই সঙ্গে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবে এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ জরুরি। যা সহজেই জেনে নেয়া যেতে পারে।