আলমডাঙ্গায় সবজি উৎপাদনে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার : এখনই প্রতিবিধান জরুরি

 

রহমান মুকুল: আলমডাঙ্গায় স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত শাক-সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বা বিষ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। হাইব্রিড জাতীয় শাক-সবজিতে বেশি পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকমিশ্রিত সবজি খেয়ে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অতিরিক্ত কীটনাশক বা বিষ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি হলেও এ ব্যাপারে বাস্তবধর্মী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কেউ নেই ।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, সবজি চাষে পোকামাকড় ও রোগবালাই সাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের হাত থেকে সবিজফসল বাঁচাতে আলমডাঙ্গার সবজিচাষিরা নির্বিচারে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বা বিষ প্রয়োগ করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সবচে’ বেশি কীটনাশক বা বিষ দেয়া হচ্ছে বেগুন, হাইব্রিড টমেটো, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, শিম, বরবটি, লালশাক, গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি, উচ্ছে, করলা, ঢেড়স ও মরিচে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কিছুটা কম কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় শসা, বরবটি, ফুলকপি, কাঁকরোল, পটল, ঝিঙা, মরিচ, পেঁয়াজ, চিচিঙা, ধুন্দুল ইত্যাদি সবজিতে। এ সকল সবজিতে কীটনাশক বা বিষ নির্বিচারে প্রয়োগ করে থাকেন সবজিচাষিরা। বেগুন, সিম, ঢেড়সসহ বেশ কয়েকটি সবজিতে প্রতিদিন কীটনাশক বা বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আলমডাঙ্গার ডম্বলপুর গ্রামের কৃষক রইচ উদ্দীনের সাথে আলমডাঙ্গা শহরের কৃষকবন্ধু বীজ ভান্ডারে এই প্রতিবেদকের দেখা। তিনি জানালেন, ১ বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। প্রতিদিন ২ জাতীয় ৪টি পৃথক কীটনাশক বা বিষ প্রয়োগ করতে হয় বেগুন ক্ষেতে। ওই দিনও তিনি ২১৮০ টাকার কীটনাশক বা বিষ ক্রয় করেছেন বলে উল্লেখ করেন। প্রটেক্ট টিডোপ্লাস, ফ্লোরা বাম্পার, মনোজিং, সুরেট, মানিক, হীরা, এ্যালবা, প্রাইজ, এনামেক হরমোন, ভাটি ম্যাক্স, রিডোবিল, সবিক্রন, একতারা পপলেন, এমিস্টার টপ, তুন্দ্রাসহ নানা জাতের কীটনাশক বা বিষ ও হরমোন বাজারে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। অপেক্ষমাণকাল না মেনেই এসব সবজি তোলা ও খাওয়া হয়। অথচ প্রায় প্রতিটি কীটনাশকেরই রয়েছে কম বেশি অবশিষ্টাংশের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব। কিছু কিছু কীটনাশক প্রয়োগের ২১ দিন পর ঐ ক্ষেত থেকে সবজি তুলতে হয়। অথচ সবজিচাষিরা বিকেলে কীটনাশক বা বিষ দিয়েই সকালে সবজি তুলে বাজারে নিয়ে যান বেঁচতে। তাছাড়া বিক্রির আগে কিছু সবজির রঙ আরও গাঢ় ও উজ্জ্বল করতে ইউরিয়া গুলানো পানি, আবার কিছু সবজিতে তুতে গোলা পানি স্প্রে করে থাকেন। যারা কেনেন, তারা তো আর জানেন না যে সেই সবজিতে কতদিন আগে বিষ দেয়া হয়েছে। ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিছু কিছু সবজি সালাদ হিসেবে কাঁচা, কিছু সবজি হালকা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। এ সব সবজি খাওয়া আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে পড়েছে। এভাবে অবিবেচনাপ্রসূত কীটনাশক বা বিষের ব্যবহার প্রতিদিন আমাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। ফলে অধিকমাত্রায় কীটনাশক বা বিষযুক্ত সবজি খেয়ে পেটের বিভিন্ন রোগ, বন্ধ্যাত্ব, বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে পানি পড়া, বমি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, শরীরের চামড়া-চোখে চুলকানি, কিডনি রোগ ও ক্যান্সারের মত জীবননাশক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গত জানুয়ারি এবং মার্চে পরিচালিত ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির রাসায়নিক ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল দূষণ পরীক্ষার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমাদের  দৈনন্দিন খাদ্য তালিকাভুক্ত সবজিগুলিতে প্রায় ৩০ শতাংশ কীটনাশকের প্রভাব থেকে যায়। আরো উদ্বেগের ব্যাপার হলো সালাদ হিসেবে বা কাঁচা মরিচের মতো সরাসরি খাওয়া যায় এমন সবজিতে প্রায় ৫০ শতাংশের মত বিষের প্রভাব শনাক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ  তো রয়েছেই। একদিকে ওই সকল কীটনাশক ব্যবহার করে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অন্যদিকে, পরাগায়নে সাহায্যকারী পোকামাকড় ধ্বংস হচ্ছে। যে কারণে ফলনও মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এসব কীটনাশক ব্যবহারের সময় যে সকল সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত তার কিছুই মানছেন না অসচেতন কৃষক। সে কারণে কৃষকরা নিজেরাও বিষাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে দিন দিন নানা রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

অথচ এ দুর্বিসহ অবস্থা থেকে সহজে পরিত্রাণের উপায় পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কৃষকবন্ধু বীজ ভান্ডারের মালিক সুরত আলী মেম্বর জানিয়েছেন, কীটনাশক বা বিষমুক্ত সবজি আবাদের জন্য আলমডাঙ্গা কৃষি অফিস বেশ কিছু কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু করেছেন। তিনিসহ বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবসায়িদের প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন উপজেলা কৃষি অফিসার। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ভয়াবহতা বোঝাতে চেষ্টা করছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, বেগুনের পোকা দমনের জন্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বিনজার লিউর যা এলাকার চাষিদের নিকট মাদুলি নামে পরিচিত। এটা পরিবেশবান্ধব। কৃষকদের নিকটও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়া লতা জাতীয় সবজির জন্য কিউলিউর নামক পরিবেশ বান্ধব কীটনাশকও বাজারে এসেছে।

আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার এ কে এম হাসিবুল হাসান জানান, এ সকল সমস্যা দূর করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের নানামুখি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আইপিএম ক্লাব, কৃষক মাঠ স্কুল, টিওটি কোর্সসহ নানা প্রকল্প। এ সকল প্রকল্পে উপকারি পোকা সম্পর্কে ধারণা দেয়া, সকল বালাইনাশকের পরিবেশকগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহাররোধ, উপকারি পোকা সংরক্ষণ ও তাদের বংশবৃদ্ধি, নিরাপদ ফসল উৎপাদন, আর্থিক অপচয়রোধ, দূষণমুক্ত পরিবেশ রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখাসহ নানা বিষয় হাতে কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। তবে কৃষি অধিদফতরের পাশাপাশি অধিক ক্ষতিকর কীটনাশক বা বিষ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি, নিয়মিত মনিটরিং ও শাস্তির ব্যবসা, কীটনাশক বা বিষ বিক্রেতাকে এ সংক্রান্ত সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্নের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে সচেতনমহলের দাবি।