আইসিটি খাতে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশয় : দাবি ও বাস্তবতায় বিশাল ফারাক

রপ্তানির সঠিক তথ্য নেই সরকারি দপ্তরে কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান করার দাবি নেটের গতি বৃদ্ধি এবং দাম হ্রাসের আহ্বান

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে তা পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ লক্ষ্যে কাজ শুরু হলেও ১০ বছরে এ খাতের রপ্তানি আয় এখনো এক বিলিয়নেরও কম। এদিকে এ খাতের প্রকৃত রপ্তানি আয় কত সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই সরকারি দপ্তরগুলোতে। বরং বিভিন্ন দপ্তর থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের বক্তব্যের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের অবস্থারও রয়েছে বিস্তর ফারাক। সরকারি দপ্তরগুলো থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০০ মিলিয়ন থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানির পরিমাণ যাই হোক না কেন বর্তমান ব্যবস্থায় মাত্র তিন বছরে তা ৫ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এছাড়া দেশে ইন্টারনেটের উচ্চমূল্যের বিপরীতে ধীরগতি, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, দীর্ঘসূত্রিতা, মানসম্মত গবেষণার অভাবসহ নানা কারণে এ খাতে সরকারি লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে বড় কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব না হওয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আধুনিক, উন্নত ও সর্বপ্রকারের সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সেখান থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করারও অনুরোধ জানিয়েছেন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।

গত ১৫ ও ১৬ এপ্রিল রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জোর দিয়েই দাবি করেছেন যথা সময়েই দেশ আইসিটি খাত থেকে রপ্তানির ৫ বিলিয়নের লক্ষ্যে পৌঁছুবে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জানান সরকার এ খাতে যথা সময়েই লক্ষে পৌঁছুবে।

তাদের এ ঘোষণার পর পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে এবং এ খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব বক্তব্যের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের বাস্ত্মবতার বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। আইসিটি খাতে সর্বশেষ অর্থ বছরের রপ্তানি আয় কত সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। সরকারের কাছে এর সঠিক কোনো তথ্য না থাকায় অনেকটা অনুমাননির্ভর ও অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়ে এগোচ্ছে খাতটি। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে সর্বশেষ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি হয়েছে ৮০০ (দশমিক ৮ বিলিয়ন) মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এ খাতের রপ্তানি আয় ২৫০ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (২৫ কোটি ৮০ লাখ)। আর ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি আয় ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ১৫০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। আইসিটি খাতের বর্তমান অবস্থা ও আগামী তিন বছরের সম্ভাবনা নিয়ে সফটওয়্যার তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান স্পন্ডন আইটি’র সিইও এমএম রহমান আকাশের কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আইসিটি খাত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি খাত হওয়া সত্ত্বেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা এ খাতে আমাদের লক্ষে পৌঁছুতে পারছি না। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে মাত্র তিন বছরে রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত করা প্রায় অসম্ভব। আর এর প্রধান কারণ আমরা যতটা বাস্তবমুখী তার চেয়ে বেশি প্রচারমুখী। এখন রপ্তানি পাঁচশ’ থেকে আটশ’ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। বার্ষিক ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ গ্রোথ নিয়ে তিন বছরে ৫ বিলিয়ন রপ্তানি করার প্রচারণাটা অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্য বলেই মনে হয়।’

এমএম রহমান আকাশ আরও বলেন, ‘ইন্টারনেটের দাম ও ধীর গতির সমস্যার পাশাপাশি এখনো আমরা পর্যাপ্ত দক্ষ লোক নিজ দেশে তৈরিতে উদ্যোগ নেই। বিদেশ নির্ভর বিশেষজ্ঞ দিয়ে একটি উৎপাদনমুখী খাতকে টেকসই রূপ দেয়া কতটা সম্ভব? এছাড়া সরকার মাত্র তিন মাসের বা আরো কম সময়ের কোর্স করাচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে একটি বিষয়ের ওপরই যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা যায় না। এর জন্য আরও দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকরী পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। আইডিবিসহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্যে কাজ করছে। কিন্তু তাদের সিট স্বল্পতার পাশাপাশি কোর্সগুলো এমন যে সব বিষয়ে কম বেশি শিক্ষা দেয়। কিন্তু তারা যদি এর পরিবর্তে এক এক জনকে পুরো সময়টা জুড়ে একেকটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ করে তুলার ওপর জোর দেয় তবে সেটিই বেশি কার্যকরী হবে। তাদের বর্তমান ব্যবস্থায় কোর্সে অংশ নেয়ারা সব বিষয়ের ভাষাভাষা জ্ঞান অর্জন করলেও কোনো বিষয়েই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে না। একজন ব্যক্তির পক্ষে বিশাল এই জগতের সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব নয়। বরং এক জন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশেষ জ্ঞান অর্জনটাই বেশি দরকার।’

তার মতে বাংলাদেশে এ খাতের গবেষণার জায়গাটি সবচেয়ে নাজুক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বিশ্বে কখন কোন বিষয়টির বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাজারে কোনটির দাম কেমন, আবার কোনোটি কম খরচে সহজে উৎপাদন করে বেশি মূল্যে বিক্রি করা যায় এসব বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন হয়। এসব বিষয়ে সরকার যদি উন্নতমানের কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখান থেকে সকলের জন্য সেবা পাওয়ার পথ সুগম করে তবে উঠতি সম্ভাবনাময় এ খাতের জন্য তা ভীষণ উপকারী হবে।’

আইসিটি নিয়ে কাজ করা আরেক জন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার মো. এনাম এলাহী মলিস্নক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা নীতি-নির্ধারণীতে। এ খাতটি এমন যে প্রতিদিনই বাজারে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে কে কতটা দ্রম্নততার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে পারবে সেটাই হলো মূল বিষয়। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা একটি বিষয়ের সমাধান করতে অনেক সময় লাগিয়ে ফেলে। যার মধ্যে ওই কাজের গুরুত্ব অনেক সময়ই কমে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের ছোট ছোট কোম্পানির পক্ষে বাজারের প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত গবেষক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একজন গবেষককে অনেক অর্থ দিতে হয়। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষক নিয়োগ দিলেও তাদের তথ্য গোপন রাখে। অন্যদের সরবরাহ করে না। সরকার যদি আধুনিক ও দক্ষ গবেষক দিয়ে কতকগুলো উন্নতমানের গবেষণাগারের ব্যবস্থা করে এবং সেখান থেকে নিবন্ধিত সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সহজে গবেষণা উপাত্ত সরবরাহ করে তবে তা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে ভীষণভাবে সহায়তা করবে।’ প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রোববার বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮ এর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেন, ‘আমরা ২০২১ সাল নাগাদ আইসিটি খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। যথাসময়েই আমরা এ লক্ষে পোঁছুবো।’

টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকও ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে একই লক্ষ্যে যথাসময়ে পৌঁছুনোর কথা বলেন। আইসিটি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে সরকারের দুই দুইজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার এ বিষয়ে মন্ত্মব্যের পর কোনো কর্মকর্তাই এ নিয়ে বর্তমান অবস্থা ও আগামী তিন বছরের বাস্তবতা কি তা নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় লক্ষ্যে পৌঁছুনো কিছুটা কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে। আশা করি সেসব করতে পারলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।’ এর আগে যায়যায়দিনের এক প্রতিবেদনে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশ এখাতে এখনো যেখানে মিলিয়নের ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে সেখানে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়া ২০১৭ সালে যথাক্রমে ১২০ বিলিয়ন, ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন, ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন, ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন এবং ৫৭৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে।