চুয়াডাঙ্গাসহ ১০ জেলায় জায়ান্ট মিলিবাগের আক্রমণ

আম কাঁঠাল লিচু ও পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফল উৎপাদনের বিপর্যায়ের শঙ্কা
স্টাফ রিপোর্টার: দেখতে শাদা তুলোর মতো। গাছের শেকড়ের ওপরের অংশে আঠার মতো লেগে থাকে। শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগের কচিপাতা, কুশি, ডগা, ফলের বোঁটায় দলবদ্ধভাবে বসে রস চুষে খায়। এতে গাছের ফুল, ফল কিংবা নতুন পাতাগুলো শুকিয়ে যায় এবং ঝড়ে পড়ে। পোকাটির নাম জায়ান্ট মিলিবাগ। উদ্ভিদের ক্ষতিকর পোকার মধ্যে একটি।
ভয়াবহ ব্যাপার হলো দেশের দশ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে পোকাটি। আম, কাঁঠাল, পেঁপে, মাল্টা, পেয়ারা, লিচু, ডালিম, নারিকেল, আতা, লেবু, বকুল ও মেহগনি গাছে এ পোকা আক্রমণ করেছে। এতে আক্রান্ত গাছ ফলন কমার পাশাপাশি মরে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি পোকাটি রোধ করা না গেলে আম, কাঁঠাল ও পেঁপে উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষকের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আক্রান্ত জেলাগুলোতে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পোকাটি দমনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষকরা জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জামালপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও লালমনিরহাট জেলায় পোকাটির আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়েছে। ওসব জেলার বিভিন্ন জায়গায় গাছের পাতা, শাখা, পুষ্পমঞ্জুরি, ফলে পোকাটির আক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে। স্বস্তির বিষয় হলো প্রধান আম উত্পাদনকারী জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখনো মিলিবাগ আক্রমণ করেনি। তবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ওই দুজেলায়ও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আমের উত্পাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জায়ান্ট মিলিবাগ গাছে খুব বেশি মাত্রায় আক্রমণ হলে গাছে কোনো ফল আসে না এবং পুরো গাছটি মারা যেতে পারে। পোকাটির জীবনচক্রের ডিম, নিম্ফ (বাচ্চা) ও পূর্ণাঙ্গ পোকা নামের তিনটি পর্যায়ের মধ্যে নিম্ফ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। স্ত্রী নিম্ফ সরাসরি গাছের ক্ষতি করে থাকে। নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ মিলিবাগ গাছের কচি শাখা-প্রশাখা, পাতা ও ফলের বোঁটা থেকে রস চুষে খায়। ফলে আক্রান্ত অংশসহ পুষ্পমঞ্জুরি, ফল শুকিয়ে ঝরে পড়ে। এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এছাড়া এই পোকার কারণে গাছে ফার্ন জন্মে। যার ফলে উদ্ভিদে সালোক সংশেষণের পরিমাণ কমে গিয়ে ফলনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। গাছে আক্রমণ প্রকট হলে সম্পূর্ণ গাছ পোকায় ছেয়ে যায়। এটি প্রধানত আম গাছের পোকা; তবে এরা পেঁপে এবং কাঁঠাল গাছকেও মারাত্মকভাবে আক্রমণ করে।
গবেষক দলটির প্রধান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ জানান, দেশে ২০০৩ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জায়ান্ট মিলিবাগ প্রথম দেখা যায়। পরে একই বছরে এটি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যায়। পোকাটির জীবনচক্র সম্পন্ন হতে এক বছর লাগে। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকা এপ্রিল মাসে মাটির নিচে আবর্জনার ভেতরে তুলার মতো থলে তৈরি করে তাতে ডিম পাড়ে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ওই ডিম ফুটে নিম্ফ বের হয় এবং খাবারের খোঁজে গাছের কচি অংশে আক্রমণ করে।
পোকা দমনের উপায়: পোকাটি দমনের জন্য এর জীবনচক্রের তিনটি পর্যায়েই নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পূর্ণাঙ্গ পোকার দেহ সাদা মোমজাতীয় পদার্থে আবৃত থাকায় কীটনাশক কার্যকর হয় না। ফলে একমাত্র পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে ফেলার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মিলিবাগ দমন করা যায়। এজন্য এপ্রিল মাসে যখন পূর্ণাঙ্গ পোকা গাছ থেকে মাটিতে নেমে আসে তখন গাছের গোড়ায় পলিথিন পেঁচিয়ে ওপরের অংশ খুলে রাখাতে হবে যেন এতে পোকা জমা হয়। পরবর্তীতে পোকাগুলো পুড়িয়ে কিংবা কেরোসিন মিশিয়ে মাটির এক মিটার গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। অন্যদিকে ডিম নষ্ট করার জন্য মে-জুন মাসে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে রোদে শুকাতে হবে। নিম্ফের গাছে ওঠা প্রতিরোধ করতে মাটি থেকে এক মিটার উঁচুতে গাছে আঠালো পদার্থ বা রাবার ব্যাণ্ড পেঁচিয়ে দিতে হবে। এছাড়া গাছের গোড়ায় নালা তৈরি করে কেরোসিন ব্যবহার ফলদায়ক হতে পারে। অন্যদিকে পোকা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই নিম্ফ পর্যায়ে প্রয়োগ করতে হবে।