উভয়কেই চর্চা করতে হবে পরমতসহিষ্ণুতার

নির্বাচন মানেই যেন সহিংসতা, কেন্দ্র দখল এবং জাল ভোটের মহোৎসব। উদ্বেগের যে, এ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার দেশের ১৩৩টি এলাকায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলাকালে অধিকাংশ স্থানেই সহিংসতা, কেন্দ্র দখল এবং জাল ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। আতঙ্কের বিষয় হলো, ভোটকেন্দ্রের বাইরে অস্ত্র হাতে মহড়া দেয়ার সচিত্র প্রতিবেদনও এসেছে সংবাদপত্রে। এছাড়া অনেক এলাকায় কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, পাল্টাপাল্টি ধাওয়াসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট ছিনতাইয়ের চেষ্টার সময় পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হতে পারে, নির্বাচন মানেই পেশিশক্তি প্রদর্শনের মহোৎসব। এ পরিস্থিতি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৩৩টি নির্বাচনের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ৪৭টি এবং বিভিন্ন পদে উপনির্বাচন বা স্থগিত নির্বাচন ৭২টি, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন ১টি, পৌরসভা নির্বাচন ৪টি ও বিভিন্ন পদে উপনির্বাচন বা স্থগিত নির্বাচন ৭টি এবং খুলনা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাধারণ ওয়ার্ডের ১টি করে উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় বৃহস্পতিবার। কিন্তু নির্বাচন চলাকালে বেশিরভাগ এলাকায় যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত পরিতাপের। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হবে উৎসবের অংশ। অথচ নির্বাচনে যেসব ঘটনার অবতারণা ঘটছে তাতে, জোরের সঙ্গেই বলা যেতে পারে, জোর করে নির্বাচিত হওয়াটা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। পরিবেশটা এমন, যাদের শক্তি আছে তারাই নির্বাচন করতে পারবে। বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবণতা আগামী জাতীয় নির্বাচনে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকারের সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হতে পারে, দেশে নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। অন্যদিকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার অভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সহিংসতা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার পূর্বাভাসকেই যেন সত্য করে তুলছে। নির্বাচন এলেই দেশের সাধারণ ভোটার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাবেন, গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ প্রবণতা একটি রাষ্ট্রের জন্যও স্বস্তিদায়ক নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী। সঙ্গত কারণেই সহিংসতাপূর্ণ এসব নির্বাচন দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। এমন ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে দেশ যে অতীতের মতো রাজনৈতিক অনিশ্চতার মুখোমুখি হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? অস্বীকার করা যাবে না যে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় রয়েছে ইসির। এখন ইসিই বা কী জবাব দেবে? গণমাধ্যমের তথ্য মতে, শুধু বৃহস্পতিবারের নির্বাচনই নয়, দু’বছর আগে অনুষ্ঠিত দেশের ৭২২টি নির্বাচনী এলাকার বেশির ভাগ এলাকায়ই সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচন হয়। শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যর্থতা ইসি এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোও অস্বীকার করতে পারে না।

নির্বাচন কমিশন এবং সরকার যখন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর- এমন কথা বলেছে তখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সাম্প্রতিক চিত্র সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাকেই যেন প্রবল করে তুলেছে। বস্তুত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিষ্কলুষ করার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। এর জন্য সবার আগে দায়িত্ব নিতে হবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে। তারা নিজেরা যতদিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণে এগিয়ে না আসবে, ততোদিন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম হবে না।

সর্বোপরি বলতে চাই, দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখাসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দল, উভয়কেই চর্চা করতে হবে পরমতসহিষ্ণুতার। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই সত্যের চর্চা করতে পারে, তাহলেই সম্ভব হবে নিষ্কলুষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, নির্বাচন কমিশন ও সরকার আন্তরিক হলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব। দেশবাসী সহিংসতামুক্ত, সুষ্ঠু নির্বাচনই প্রত্যাশা করে।