শুধু ২০ জনের নয় দীর্ঘদিন ধরে বহু মানুষেরই হারাতে হয়েছে চোখ

চুয়াডাঙ্গা ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের সকল কার্যক্রম বন্ধ

ডাক্তারের অদক্ষতার কারণেই এমন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষের দাবি ওষুধ দায়ী
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় অস্ত্রোপচারের কারণে ২০ নারী-পুরুষের চোখ তুলে ফেলার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার পর অভিযুক্ত ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একইদিনে অস্ত্রোপচার করা ২৪ জনের মধ্যে ২০জনের চোখে ইনফেকশনের পর চোখ তুলে ফেলতে হওয়ার ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের পর পূর্বে একই স্থানে একই চিকিৎসকের ভুল অপারেশনের কারণে আরও অনেকেই চোখ হারিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে বলেছেন, ওই চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শাহীনসহ চিকিৎসা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অপরদিকে একসূত্র বলেছে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের তরফে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অপর এক সূত্র বলেছে, আসছে রোববারই উচ্চ আদালতে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরণের রিট হতে পারে।
অরোব্লু নামক ভারতীয় একটি ওষুধের ব্যাকটেরিয়া থেকে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি হাজি আসাদুল হক জোয়ার্দ্দার লেমন বলেছেন, চুয়াডাঙ্গার ওই ইম্প্যাক্টে ডা. শাহীন অপারেশন করে আমারও চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে দৃষ্টি শক্তি। ঝাপসা দেখা থেকে স্বচ্ছ দেখার আশায় ডা. জিপুর প্ররোচনায় চুয়াডাঙ্গা ইম্প্যাক্টে বছর দেড়েক আগে চোখে অপারেশন করিয়ে যখন তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় তখন ওনারা ন্যাকামো মার্কা কথা বার্তা বলতে শুরু করেন। উপায় না পেয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও যখন সুস্থতা পেলাম না তখন ভারতের ভেলরেও গেলাম। সেখানেও চিকিৎসকেরা কিছু করতে পারলেন না। বললেন, প্রথম অপারেশনে ত্রুটির কারণেই এ অবস্থা। ওই ডা. শাহীনসহ ইম্প্যাক্টের অপারেশন থিয়েটার সম্পর্কে আগেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিলো। তাহলে বহু মানুষকে চোখ হারাতে হতো না। আশাদুল হক জোয়ার্দ্দার লেমনের মতোই ক্ষোভ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গা ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারের চক্ষু কনসালটেন্টের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা চুয়াডাঙ্গা বাগানপাড়ার বাসিন্দা আরজুমান নাহার। তিনি বললেন, ‘২০১৬ সালের ১ আগষ্ট ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে চোখের ছানি অপসারণ করিয়ে ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। ডান চোখের ছানি সরিয়ে লেন্স বসানোর জন্য ইম্প্যাক্ট হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ দাবিদার ডা. শাহীন প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে তার চোখের পর্দা কাটাকুটি করেন। এক পর্যায়ে ডা. শাহীন জানান, সমস্যা বেশ জটিল এখন লেন্স বসানো যাবে না। একমাস পর আবার অপারেশন করতে হবে। দৃষ্টিহীন রক্তাক্ত চোখ নিয়ে একদিন পর বাড়ি ফিরি। হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডা. জিপু বিষয়টি বিরল ঘটনা দাবি করে অপারেশনের টাকা ফেরত দেন। ইম্প্যাক্ট হাসপাতালের ছাড়পত্রে লেখা হয় চোখে মেথিলিন ব্লু ইনজেকশন প্রয়োগ করার পর কর্ণিয়া ঘোলা হয়ে গেছে, একমাস পর মেথিলিন ব্লু ইনজেকশন ছাড়া অপারেশন করাতে হবে।’ একদিকে ডায়াবেটিক, ব্লাড প্রেশার অপরদিকে একচোখের আলো নেই। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েন অবসরপ্রাপ্ত এই স্কুল শিক্ষিকা ও তার পরিবার। দিনের পর দিন ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে ঘুরে হতাশ হয়ে শরণাপন্ন হন স্থানীয় চক্ষু চিকিৎসক ডা. ফকির মোহাম্মদের কাছে। তার পরামর্শ অনুযায়ী প্রায় ৪ মাস পর খুলনার একটি চক্ষু হাসপাতালে আবার অপারেশন করিয়ে কোনোমতে রক্ষে মেলে। এখনও ক্ষতিগ্রস্ত চোখে ব্যথা অনুভব করেন। আরজুমান নাহার আরও অভিযোগ করে বলে, ‘ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে অপারেশনের দিন সকালে শরীর থেকে কোনো রক্ত না নিয়েই ব্লাড সুগারের রিপোর্ট প্রদান করা হয়। এ রিপোর্ট নিয়ে আপত্তি তুললে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চান।’ এদিকে ২০ জনের মধ্যে যে একজনের চোখ রেখেই চিকিৎসা চলছে তিনি হারদীর হতদরিদ্র হায়াতন নেছা। তার চোখে এখন এতোটাই তীব্র যন্ত্রণা যে, ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরলেও এখানে ওখানে ছুটছেন নিরাময়ের আসায়। গতকালও তিনি তার মেয়ে ফরিদাকে সাথে নিয়ে চুয়াডাঙ্গার হাসপাতালে আসেন। সেখান থেকে ইম্প্যাক্টে গেলে ধমক দিয়ে বলা হয়, চোখের যন্ত্রণার বিষয়ে লোকজনকে বলে বেড়ালে আর কোনো ব্যবস্থায় করা হবে না। হতদরিদ্র হায়াতনের মেয়ে ফরিদা এ হুমকি শুনে ফরিয়াদ জানিয়ে বলেছেন, আমরা গরিব মানুষ। মায়ের চোখে যন্ত্রণা। সত্যি কথা বলেও এখন শুনতে হচ্ছে ধমক। আমরা কোথায় যাবো তাও তো বুঝতে পারছি না।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারে গত ৫ মার্চ ২৪ রোগীর চোখে অপারেশন করা হয়। পরবর্তীতে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন তারা। ২০ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে ১৯ নারী-পুরুষের চোখ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তুলে ফেলতে হয়েছে। এ ঘটনায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়ে ওই হেল্থ কেয়ার সেন্টারের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন। বুধবার গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত টিম আগামী ২ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য প্রশাসনের তরফে গঠিত তদন্ত দলের পক্ষে ইতোমধ্যেই ইম্প্যাক্টের অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতির নমুনাসহ অপারেশনের কাজে ব্যবহৃত ওষুধ ও পথ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের অভিযুক্ত আই কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ শাহীনের সকল শিক্ষাসনদের ফটোকপি সংগ্রহ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে শুধু ওই ২০ জন নয়, দীর্ঘদিন ধরে এখানে অপারেশন করা অসংখ্য রোগী তাদের দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি আশাদুল হক জোয়ার্দ্দার অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ২৪ নভেম্বর ওই চিকিৎসা কেন্দ্রে আমার ডানচোখ অপারেশন করিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আমার চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক ডাক্তারকে চোখ দেখিয়েছি। তারা সবাই অপারেশনের ভুলের কারণে এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন।’ তিনি বলেন ‘ওরা অসংখ্য মানুষের চোখ এভাবে নষ্ট করে দিয়েছেন। ওদের শাস্তি হওয়া দরকার।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চুয়াডাঙ্গার একজন ডাক্তার বলেছেন, যেসব রোগীর চোখ তুলে ফেলতে হয়েছে পরবর্তীতে তাদের আরও ফাঁড়া রয়েছে। এ কারণে অপর চোখটিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি ওই ব্যাকটেরিয়া নার্ভ দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে রোগীর।’ এমন আশঙ্কার কথা স্বীকার করেছেন খোদ অভিযুক্ত ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারের প্রশাসক ডা. শফিউল কবীর। তিনি মাথাভাঙ্গাকে বলেন ‘ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসার সব ব্যয়ভার নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে।’ তিনি জানান, ‘৫ মার্চ ৫টা বক্স থেকে ভারতীয় ‘অরোল্যাব’ কোম্পানির ‘অরোব্লু’ নামক ওষুধ ২৪ রোগীর চোখে পুশ করা হয়। অভিযোগ ওঠার পর অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে ওই বক্সে থাকা অবশিষ্ট দুই শিশি ওষুধ মহাখালীর আইসিডিডিআরবিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। তারা ১৫ মার্চ রিপোর্ট দিয়েছেন। তাতে অরোব্লু নামক ওষুধে ‘গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার’ উপস্থিতি পান। একই সঙ্গে আক্রান্ত এক রোগীর চোখের পুঁজ সংগ্রহ করে ইসলামিয়া হাসপাতালে পরীক্ষা করা হয়। সেখানেও গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। তাই প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি ভারতের অরোল্যাবের অরোব্লু ওষুধই এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী। ডাক্তার নয়।’
এদিকে, চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারসহ সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়ায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলমের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে খুলে দেয়ার চাপ আছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে সিভিল সার্জন এ বিষয়টি অস্বীকার করে মাথাভাঙ্গাকে বলেছেন ‘কোনো চাপ নেই। নিয়ম অনুযায়ী যা করার সব করা হবে।’
উল্লেখ্য, ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারে রোগীদের একটি করে চোখের অপারেশন করা হয়। পরদিন ছাড়পত্র দেয়া হয়। বাড়ি ফিরে ২০জনের চোখে যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এরা পরবর্তীতে একই চিকিৎসা কেন্দ্রে ফিরে তাদের চোখে যন্ত্রণার কথা জানালে বাইরের চোখের ডাক্তারের নিকট যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। গত ২০ থেকে ২২ মার্চের মধ্যে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ইনফেকশনের চোখগুলো তুলে ফেলতে হয়েছে। এ ঘটনায় বুধবার চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম তদন্ত কমিটি গঠন করেন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জুনিয়র চক্ষু কনসালটেন্ট ডা. শফিউজ্জামান সুমনকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডা. সুমন বলেন, ২ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে শনিবার হাসপাতালটি পরিদর্শন করবো। কোনো প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করা হবে না। এদিকে চোখের অপারেশন করিয়ে চোখ হারানো পরিবারগুলোর অধিকাংশের তরফেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক প্রকৃত দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণেরও দাবি জানানো হয়েছে।