বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দুই মেয়েকে ইন্সেপেক্টর জালাল

এখন থেকে একা একাই কোচিংয়ে যেতে হবে
স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (পশ্চিম) পরিদর্শক জালাল উদ্দিন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে স্ত্রী বিনা পারভীনের ফোন পেয়েছিলেন। সেই ফোনে স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুমি কখন আসবে বাসায়?’ জবাবে তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমার আসতে ভোর হয়ে যাবে। তুমি দারোয়ানের কাছে চাবি রেখে দিও।’
জালাল আর ফিরে আসেননি। ফোনও করেননি। রাত ১২টার দিকে একবার ফোন করে দেখি তার ফোন বন্ধ। এর আগেও ফোন বন্ধ থাকতো। পরে আবার কল ব্যাক করতো। আজ ও ফোন খোলেওনি, কলও ব্যাক করেনি। এরপর রাত দেড়টার দিকে একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন করে স্কয়ার হাসপাতালে যেতে বলা হয়। এরপর ফুফাতো বোনকে ডেকে তার গাড়িতে স্কয়ার হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি জালাল নেই।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে জানাজাস্থলে এভাবেই কান্নায় আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন নিহত জালাল উদ্দিনের স্ত্রী বিনা পারভীন। এ সময় তিনি বারবার জানাজার জন্য রাখা স্বামীর কফিনের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
রাজারবাগে মায়ের সঙ্গে আসে দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস তৃপ্তি ও ফারহানা আফরোজ তূর্যা। তৃপ্তি দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ও তূর্যা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এ দুজনই ভিকারুন নিসা নূন স্কুলে পড়ে। তারাও মায়ের সঙ্গে কান্নায় আবেগী হয়ে ওঠেন।
রাজারবাগে উপস্থিত জালাল উদ্দিনের স্ত্রীর ফুফাত বোন রিমপা খাতুন। যার সঙ্গে এ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঢাকার মগবাজারে থাকলেও জালাল উদ্দিনের বাসাবোর বাসায় বেশ যাতায়াত ছিলো। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৭টায় জালাল উদ্দিন বের হয়ে যান। এরপর সারাদিন আর বাসায় ফেরেননি। প্রতিদিন বাবার সাথেই দুই মেয়েও কোচিংয়ে যান। গত রোববার সকালে মেয়েদের বলেছিলেন, আমি আর তোমাদের কোচিংয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। তোমরা ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে। এখন থেকে একাএকাই কোচিংয়ে যেতে হবে। কারণ আমার অফিসে ৯টার আগেই ঢুকতে হবে। আজ থেকে সত্যিই সত্যিই মেয়েদের আর কোচিংয়ে নিয়ে যাবেন না জালাল উদ্দিন। রিমপা খাতুন বলেন, ‘সকালে বেরিয়ে যেতেন। আর রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরতেন। কাজকেই উনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
অপারেশনে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন? জানতে চাইলে রিমপা বলেন, ‘না। অপারেশনে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।’ মো. জালাল উদ্দিন ১৯৭০ সালের ১৫ মে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ভোলপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল পদে যোগ দেন। চাকরির ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ১ আগস্ট এএসআই পদে, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর এসআই এবং ২০১৭ সালের ১৯ আগস্ট পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান।

২০১৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগে পরিদর্শক পদে বদলি হন। তিনি ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পিপিএম পদক গ্রহণ করেন। কুষ্টিয়ার মেয়ে বিনা পারভীনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জালাল উদ্দিন।
গত সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকার মিরপুর মধ্যপীরের বাগ এলাকার একটি বাসায় সন্ত্রাসী রয়েছে এমন সন্ধান পেয়ে অভিযানে গেলে সন্ত্রাসী টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এরপর তারা পেছন দিয়ে গ্রিল বেয়ে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ জালাল উদ্দিনকে উদ্ধার করে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের পরিবারের তিন সদস্যকে আটক করে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বাসা মালিকের নাম হেলাল উদ্দিন। তিনি এবং তার স্ত্রী লাভলী বেগম অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। এখন বাসাটির মালিক তার মেয়ে শারমিন আক্তার। শারমিন আক্তার ওই এলাকার পাবনা গলিতে আরেক বাসায় থাকেন। এজন্য তিন তলা ওই বাসাটি দেখভাল করেন শারমিন আক্তারের মামা মিঠু মিয়া। মিঠু মিয়া বলেন, পুলিশের ওপর হামলা করে পালানো সন্ত্রাসীর নাম মো. হাসান। সে ওই বাসার তিন তলার ওপরের ছাদে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে ৭ মাস ধরে আছেন। প্রথমে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলো হাসানের মা। এরপর হাসান তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাসায় ওঠে। পুলিশ হাসানকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। জানাজা শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ পরিদর্শক জালাল শেখ হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পাকড়াও করে আইনের আওতায় আনা হবে। সেই সঙ্গে হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

ঢাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ডিবি ইন্সেপেক্টর
জালালের গ্রামের বাড়ি কালীগঞ্জে শোকের মাতম
শিপলু জামান: ঢাকার মিরপুরে অভিযান চালানোর সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ডিবি ইন্সপেক্টর জালাল উদ্দিন (৪৮) তিন মাস পর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ভোলপাড়া গ্রামে আসতে চেয়েছিলেন। ছেলের অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন বৃদ্ধা মা আয়েশা বেগম। ছেলে ঠিকই এলো। কিন্তু জীবিত নয়, কফিনবন্দি হয়ে। নিহত জালালের দুই মেয়ে রয়েছে। তার বড় মেয়ে তৃপ্তি ঢাকা ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী এবং ছোট মেয়ে তুর্জা একই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। পরিবার নিয়ে তিনি ঢাকার সবুজবাগ থানার পূর্ব বাসাবোর একটি বাড়িতে থাকতেন।
ভোলপাড়া গ্রামের মৃত বিশারত ম-লের ৭ সন্তানের মধ্যে নিহত জালাল উদ্দিন ছিলেন পরিবারের ৩ নম্বর সন্তান। তারা ৫ ভাই ও -ুই বোন। গ্রামের বাড়িতে যৌথ পরিবার হিসেবে অন্যান্য ভাইয়েরাও একসাথে বসবাস করে। কোনোভাবেই পরিবারটি মেনে নিতে পারছে না এই মৃত্যুর সংবাদ। নিহতের পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাত ২টার দিকে নিহতের পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর সংবাদ পান। নিহত জালালের অন্য ভাইয়েরা পরিবার নিয়ে আলাদা বসবাস করেন। একমাত্র জালাল পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করেন। এছাড়া ছোট ভাই বাদশা কুয়েত প্রবাসী এবং অন্য ভাইয়েরা কৃষিকাজ করেন। মায়ের দেখভাল করতেন তিনি।
নিহত গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক জালাল উদ্দিনের বাড়িতে মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, তার মুত্যুর সংবাদ গ্রামের বাড়িতে আসার পর শোকের মাতম শুরু হয়। গ্রামের লোকজন তাদের বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন। ভোলপাড়া গ্রামে প্রায় ২ বছর আগে দুই তলা একটি বাড়ি তৈরি করার কাজ শুরু করেন জালাল। এখনো শেষ হয়নি বাড়িটির কাজ। কিন্তু এই বাড়িতে আর ওঠা হলো না জালাল উদ্দিনের।
এদিকে, নিহত জালাল উদ্দীনের বৃদ্ধ মা আয়েশা খাতুন নিহত ছেলের ছবি নিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন আর বলছেন, আমার ছেলের সাথে আর দেখা হবে না। আমাকে না বলে আমার জালাল আমার আগে চলে গেল। দুই তলা বাড়ি থুয়ে কোনো তলায় যাচ্ছেরে। এই বাড়িটিতে তুই আমাকে রাখতে চেয়েছিলি। এখন আমি কার সাথে থাকবো।
নিহত জালাল উদ্দীনের বাল্যবন্ধু গোলাম রসুল জানান, আমরা গোপালপুর হাইস্কুলে পড়তাম। জালাল দারুণ মেধাবী ও সামাজিক মানুষ ছিলো। চাকরিতে যোগ দেয়ার পর কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করার স্বীকৃতিস্বরূপ জালাল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন বলে জানান এই বাল্যবন্ধু।
উপজেলার ভোলপাড়া গ্রামের শুকুর আলী জানান, মানুষের সাথে খুব সহজে মিশতেন। তিনি এই এলাকার সম্পদ ছিলেন। মানুষের বিভিন্ন সমস্যায় সে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতো। এমন উচ্চ পর্যায়ে গ্রামের আর কেউ চাকরি করে না। ছুটতে বাড়ি এলে পরিচিত সবার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দেখা করতো। তার মৃত্যুতে এলাকার মানুষ খুব কষ্ট পেয়েছে।
কালীগঞ্জ থানার ওসি মিজানুর রহমান খান জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে তিনি মরদেহ গ্রহণ করবেন। এরপর নিহত কর্মকর্তার ধর্মীয় সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাত ১২টার সময় রাজধানীর মিরপুরের পীরেরবাগের তিনতলা একটি বাড়িতে কয়েকজন সন্ত্রাসী অবৈধ অস্ত্র জড়ো করছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। দুপক্ষের গোলাগুলির সময় পরিদর্শক জালাল উদ্দিনের মাথায় গুলি লাগে। এসময় তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। নিহত জালাল উদ্দিন ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদকপ্রাপ্ত হন পুলিশের এই কর্মকর্তা। গত তিন মাস পূর্বে পদোন্নতি সূত্রে তিনি সূত্রাপুর থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (পশ্চিম) বিভাগের পল্লবী জোনাল টিমে যোগদান করেন।
কান্না জড়িতকণ্ঠে মা আয়েশা বেগম বলেন, ৩ মাস আগে ছেলে জালাল উদ্দিন বাড়িতে এসেছিলো। কয়েকদিন থাকার পর ঢাকায় যাওয়ার আগে বলে, ৩ মাস পর আবার আসবো। তিনি আরও বলেন, সবাই বেঁচে গেল আর আমার ছেলে মারা গেল। এ কষ্ট আমি আর ভুলতে পারছি না। মৃত্যুর খবরে কালীগঞ্জের ভোলপুর গ্রামে মানুষের মধ্যে শোক বিরাজ করছে। হঠাৎ করেই মধ্যরাতে তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অনেকটাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে তার বৃদ্ধা মা-সহ পরিবারটি।
তুই এবার বাড়ি এসে আমার সাথে তো আর কথা বলবি নে। আমার ওষুধ কে কিনে দেবে। আমার জন্য ফল আর কেউ কিনে আনবে না। এভাবে প্রলাপ করতে থাকেন বৃদ্ধা মা আয়েশা খাতুন।
মেজভাই আলাউদ্দিন বলেন, গ্রামে পাশের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার পর পুলিশে যোগ দেয় তার ভাই। প্রমোশন পেয়ে ইন্সপেক্টর হয়েছিলো। অভিযানকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে জালাল উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন পরিবারটি।