স্টাফ রিপোর্টার: গত মাসে শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় সবগুলো বিষয়েরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কোনো বিশেষ উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংঘটিত এসব অনিয়ম রোধে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় সেটা রোধ করা যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন পক্ষ দাবি করেছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো মনে করে, প্রশ্নফাঁস ও ডিজিটাল অনিয়ম রোধে সরকার কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখলেও এসব সিন্ডিকেট অতীতের মতোই এখনো সক্রিয় রয়েছে।
এ অবস্থায় এসএসসির মতোই এই পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসকে তাই অনেকটা অবধারিত বলেই ধরে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সরকার আগামী বছর থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বললেও এপ্রিলের দুই তারিখে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা নিয়ে কোনো ধরনের উচ্চবাচ্চ করছে না। সরকারের শীর্ষপর্যায়ে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি।
সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে একাধিক সিন্ডিকেট জড়িত থাকায় সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য। আর এ জন্য প্রশ্নপত্র ছাপানোর পরিবর্তে অন্য পদ্ধতি নিয়েই কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে সেই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে- এটাকে ধরে নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে তারা।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে আমরা চেষ্টা করছি। আগামী এইচএসসি পরীক্ষা অতি অল্প সময়ের মধ্যে হওয়ায় বড় কোনো পরিবর্তন এই সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। তবে এর পরও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছি, যেগুলো আগে নিইনি। আশা করছি, এসব বেশ কার্যকর হবে। এর পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবো।’
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের পর শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসএসসির পর এইচএসসিতেও প্রশ্নফাঁস হবে- এটাকে মন্ত্রণালয় অবধারিত ধরে নিয়েই কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে, ফোন নম্বর দিয়ে প্রশ্নফাঁস করা হলেও প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের সন্ধান এখনো করতে পারেনি সরকার। এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক হলেও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কার্যত এখনো অন্ধকারেই রয়েছে। এসএসসিতে প্রশ্নফাঁসের দায়ে ৫২টি মামলা এবং ১৫৩ জনকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় অভিযুক্ত ও আটকদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী বা অভিভাবক। এর বাইরে যে কয়জনকে আটক করা হয়েছে, তারা মূলত ফেসবুকে প্রশ্নফাঁস-সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট করেছে বলে অভিযোগ। এছাড়া পরীক্ষার সময় বন্ধ থাকা কোচিংগুলোরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন কোথা থেকে ফাঁস হয়েছে, কে প্রথমে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছে, এসব বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেনি পুলিশ, র্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
এ প্রসঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্মকমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, ‘যারা প্রশ্নফাঁসের এ ধরনের আগাম ঘোষণা দিচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এসব পেজের অ্যাডমিনদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘আগাম ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস- এটি তো ভাবাই যায় না। যদি খবরটি সত্য হয়, তাহলে এ বিষয়ে মন্তব্য করার কোনো ভাষা আমার নেই। তবে যারা এভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস করছে, তাদের কেন আটক করা যাচ্ছে না, সেটাও আমার বোধগম্য নয়।’
শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞও এ বিষয় সঙ্গে আলাপকালে প্রযুক্তি বিষয়ে রাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসার হলেও এর নিরাপত্তার দিকটি প্রথম থেকেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আর এ কারণেই প্রশ্নফাঁসের মহামারি দেখা দিয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের বাইরে যারা আটক হয়েছে, তাদের একটি অংশ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মালিক, শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতেই এসএসসি পরীক্ষার সময় দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ রেখেছিলো। এরপরও দেখা যায়, এসব কাজের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যাদেরই সরকার আটক করেছে, তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত। আর এ কারণে শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা কোচিং সেন্টার টিকিয়ে রাখা এবং এর সঙ্গে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের জড়িত হওয়ার বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুলে মেয়েকে পড়ান হালিম সরদার। তিনি বলেন, ‘কোচিং সেন্টারের কারণেই প্রশ্নফাঁসের এই ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব কোচিংগুলো প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সর্বত্র যোগাযোগ রাখে। তারাই এসব কাজের সঙ্গে জড়িত। সরকার পরীক্ষার সময় কোচিং বন্ধ রেখে এর সঙ্গে যুক্তদের আরও ভালোভাবে প্রশ্নফাঁসের সুযোগ করে দিয়েছে। কোচিং খোলা থাকলে সেখানে ক্লাসও করাতে হতো। ফলে প্রশ্নফাঁসের জন্য সময় দেয়ার সুযোগ কম পেত। কিন্তু পরীক্ষার সময় কোচিং বন্ধ থাকায় তারা পূর্ণ সময়ই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজে লাগিয়েছে। এতে প্রশ্নফাঁস আরও বেশি হয়েছে।’