শ্রমবাজারে যোগ্যতা প্রমাণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে নারী

মেহেরপুরে শ্রমিক সঙ্কট পূরণ করছে নারী শ্রমিক

মাজেদুল হক মানিক: ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর, নারী পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতার এ লাইনটির যথার্থতা আবারও প্রমাণ হয়েছে শ্রম বাজারে নারীদের অবদান। কায়িম পরিশ্রমে পুরুষের মতোই মানিয়ে নিচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। বর্তমান সময়ের শ্রমিক সঙ্কটের বড় অংশও পূরণ করছেন তারা। মেহেরপুর জেলায় বিভিন্ন খাতে নারী শ্রমিকদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। নির্মাণ ও হস্তশিল্প খাত ছাড়াও কৃষিক্ষেত্রে এখন নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানার নির্মাণ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ শ্রমিক সমস্যা কাটিয়ে তুলছে। অপরদিকে পুরুষদের সাথে সমানতালে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক অসহায় নারী। মেহেরপুরের ইকুড়ি গ্রামের মধ্যবয়সী আসমা খাতুন। ছেলের জন্মের পর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতেন। অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবা ও শিশুসন্তান নিয়ে দুঃখের অথৈ সাগরে পড়েছিলেন আসমা খাতুন। অন্য নারীদের মতো তিনি ভিক্ষার ঝুলি হাতে তুলে নেননি। আত্মপ্রত্যয়ী এ নারী গ্রামের পুরুষ শ্রমিকদের সাথে মাটি কাটার কাজ শুরু করেন। তার সফলতা দেখে অসহায় আরও অনেক নারী তার সাথে কাজে যোগ দেন। একপর্যায়ে ৩০-৪০ জন নারী-পুরুষের সমন্বয়ে একটি দল গড়ে ওঠে। এখন ওই দলের সর্দ্দার হিসেবে শ্রমিকদের কাজ পরিচালনা করছেন আসমা খাতুন। আসমা খাতুনের মতো অনেক নারী আজ শ্রমিকের কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন।
জানতে চাইলে আসমা খাতুন বলেন, পুরুষের চেয়ে নারীদের শারীরিক সক্ষমতা কম হলেও কাজের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে না। আমার দলের মেয়েরা পুরুষের সাথে সমানতালে কাজ করেন। আমি বিভিন্ন মালিকের কাজের মৌখিক চুক্তি করি। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় দল ভাগ করে কাজ সম্পাদন করে হাজিরা নিয়ে বাড়ি যাই। আসমা খাতুনের ছেলে এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। পিতা-মাতা ও ছেলেকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে মেহেরপুর জেলায় বাড়ি নির্মাণের হিড়িক চলছে। বিশেষ করে প্রবাসীরা গ্রামেও দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা তৈরিতে ব্যস্ত। এছাড়াও কৃষি প্রধান মেহেরপুর জেলায় সব সময় শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। ফলে নির্মাণ ও কৃষি ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা এখন জায়গা করে নিয়েছেন।
শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাচ্ছেন। নির্মাণাধীন কোনো বাড়ি-অফিসে মাটি ভরাট, রাস্তার মাটি কাটা, বালু সরানো, রাস্তা নির্মাণ কাজসহ শ্রমিকের প্রায় সব কাজেই নারী শ্রমিকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকদের সমমান ৩০০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। এ মজুরির জন্য সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। নির্ধারিত এ সময়ের পরেও চুক্তিতে কিছু কাজ করে বাড়তি কিছু আয় হয়। গড়ে প্রতি মাসে একজন নারী শ্রমিক ১০-১২ হাজার টাকা আয় করেন। নারী শ্রমিক হিজলবাড়িয়া গ্রামের ছামেনা খাতুন বলেন, আমাদের সাথে যারা কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা। গরিব পরিবারের সদস্য যাদের অন্য কোনো আধার নেই তারাই মূলত শ্রমিকের কাজ করেন। এখন কাজের অভাব নেই। সারা বছরই আমাদের কাজ থাকে। নারী শ্রমিকদের দলের সদস্য জুগিন্দা গ্রামের আলফাজ উদ্দীন বলেন, মাটি কাটার কাজে একজন নারী ও একজন পুরুষের জোড়া করা হয়। নারীরা মাটি কাটতে পারেন না। আমরা মাটি কেটে ঝুড়ি পুড়ে দিলে তারা মাথায় করে নির্দিষ্ট স্থানে ঢেলে দেয়। আমাদের একটু বেশি পরিশ্রম হলেও টিমের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করি। হাজিরাও সমান নেয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এখন নারী শ্রমিকদের দেখা যায়। নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমন্বয়ে একটি দল গঠন হয়। ওই দলের সর্দ্দার তাদের কাজ পরিচালনা করে। সর্দ্দারের সাথে কাজের মালিকের কথাবার্তা হয়। সেই মোতাবেক দলের সদস্যদের বিভিন্ন উপদলে ভাগ করে প্রতিদিনের কাজ সম্পাদন করা হয়ে থাকে। কাজ শেষে সর্দ্দারের কাছ থেকে মজুরি বুঝে নেয়। জেলা শহর, কেদারগঞ্জ, আমঝুপি, গাংনী ও বামন্দীসহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিদিন ভোরে জড়ো হয় নারী-পুরুষ শ্রমিকরা। সেখান থেকে সর্দ্দারের নির্দেশ মতো কাজে যোগদান করেন। ইমারত নির্মাণ শ্রমিক সমিতি সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, এলাকার শ্রমিক শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ বিদেশমুখী। ফলে সব কাজেই শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে। বিশেষ করে নির্মাণ কাজে শ্রমিকের বড় সঙ্কট। তবে নারীরা এ কঠিন কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় সাশ্রয়ী হচ্ছেন মালিকপক্ষ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ডক্টর আখতারুজ্জামান বলেন, কৃষিতে বিপ্লব হলেও শ্রমিক সঙ্কটে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ খাতে আরও নারী শ্রমিক সম্পৃক্ত হচ্ছে। এতে নারী শ্রমিক ও কৃষক উভয়ই লাভবান হচ্ছেন।