পিতার ওপর নৃশংসতা দেখে মানসিক ভারসম্য হারিয়েছে সন্তান

চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়ার শোকার্ত পরিবারের অনাহারি মুখগুলো যেনো ছুড়ে দিচ্ছে হাজারো প্রশ্ন

বাড়ির আঙিনায় শেকলে বাঁধা স্বামীর পাশে অসহায় স্ত্রীর করুন আকুতি

শামসুজ্জোহা রানা: চোখের সামনে পিতাকে বেঁধে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মাথায় শাবল গেঁথে খুনের দৃশ্য দেখে ছেলে শরীফ (২৫) মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তাকে সামলাতে তারই পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা, পেট চালানোর মতো একমুঠো চালও নেই তাদের বাড়িতে। গতকাল বুধবার দুপুরে সরেজমিন গেলে শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের অনাহারি মুখ যেন সমাজের ওপরই ছুড়ে দিয়েছে হাজারো প্রশ্ন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের গাড়াবাড়িয়ার মালিতাপাড়ার হতদরিদ্র আশরাফ উদ্দীন গত ২৭ জানুয়ারি দিনে দুপুরে নৃশংসভাবে খুন হন। তার ৪ ছেলে দু’মেয়ের মধ্যে শরীফ দ্বিতীয়। চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের গমপট্টিতে খ-কালীন লেবারের কাজ করতেন তিনি। এক সন্তানের জনক শরীফ উদ্দীনসহ তার অপর ভাই-বোনেরা চেষ্টা করেও পিতার প্রাণরক্ষা করতে পারেননি। খুন মামলা হয়েছে। মামলার মূল আসামি একই গ্রামের বাগানপাড়ার মৃত মকছেদ ম-লের ছেলে ইকরামুল হক ইকরা ও রসুল প্রথমে ও পরবর্তিতে ১৬ আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে। ইকরা ও রসুলকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুল খালেক। ইকরার স্ত্রী ইতি, ছেলে স্বপ্নীলসহ তিনজন উচ্চ আদালত থেকে ৮ সপ্তাহের জামিনে থাকলেও এ সময়ের মধ্যে নি¤œ আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। গতপরশু ইকরাসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা ও নির্মম ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে গ্রামবাসীসহ এলাকার গণ্যমান্যরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছে। অপরদিকে শোকার্ত বাড়িতে ঘটে চলেছে একের পর এক ঘটনা।
মেজো ছেলে শরীফ উদ্দীন ঘটনার দু’দিন পর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। ভালাইপুর এলাকার কবরস্থানে গিয়ে কবর ঘেরা কাবারিতে আগুন ধরিয়ে দিলে উম্মাদ হিসেবে এলাকাবাসীর রোষানলে পড়ে। অবশ্য পরে পরিচয় পাওয়ার পর এলাকাবাসীর ভুল ভাঙে। তারাই শরীফকে তার বাড়ি গাড়াবাড়িয়ায় পৌঁছে দেন। নিজবাড়িতে ফিরে সে কখনো নিজেকেই শেষ করার জন্য আঘাত করতে থাকেন, কখনো নিজের ঘরেই আগুন ধরিয়ে দিতে যান। মাঝে মাঝে তার পিতার খুনিদের বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করেন। গ্রামের প্রভাবশালী খুনিদের হাত থেকে পিতাকে রক্ষা করতে না পারার কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন বলে জানান তার গ্রামের সাধারণ মানুষ। গত শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিনের নিকট নেয়া হয়। তিনিও মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, চোখের সামনে নৃশংসতা এবং আপনজনকে রক্ষা করতে না পারার কষ্টে এমনটি হতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসায় শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মানসিক রোগীর চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার প্রয়োজন হবে।
শরীফ উদ্দীনকে তার বাড়িতেই শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে। স্ত্রী বলেছেন, চাল-গমপট্টিতে লেবারের কাজ করতো। আমাদের ৫ বছরের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। ওই লেবারের কাজ করে দিন আনা দিন খাওয়ার মতো করেই চলতো সংসার। শ্বশুর খুনের পর যে মানুষটা আমাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতো, সে এখন পিতার হত্যাকা- দেখে পাগল। স্বামীকে বেঁধে সামলাতে হচ্ছে। অথচ বাড়িতে একমুঠো চাল নেই। খাবার নেই। কিছুুদিন আগে ব্যবসার জন্য কিছু বাটখারা কিনে এনে বাড়িতে রেখেছিলো। ওই বাটখারা বিক্রি করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিছু ওষুধ কিনেছি। ব্যবসা করবে বলে সমিতির কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়ে যে বাটখারা কিনিছেলো, সেই বাটখারা বিক্রি করে ডাক্তার দেখালাম। এখন সমিতির লোকজন বলছে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি ৩শ টাকা করে দিতে হবে। একদিকে খাওয়া নেই, অন্যদিকে স্বামীকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা। তারপর সমিতির কিস্তি। আমার এ কষ্ট এখন কাকে বলবো? কে বাড়াবে সহযোগিতার হাত।
গ্রামবাসী বলেছে, আশরাফ উদ্দীন কখনো ভ্যান চালাতো, কখনো মাঠের কাজ করে সংসার চালাতো। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে গ্রামের প্রভাবশালীরা তাকে খুন করলো। আশরাফ উদ্দীন যেমন ছিলেন সহজসরল হাসি-খুশি মানুষ, তেমনই তার ছেলেরাও। বড় ছেলে আরিফ অটো চালাতো। পিতার হত্যাকা-ের পর ওই অটো হাতছাড়া হয়। ফলে তার বাড়িতেও এখন চুলো না চলার অবস্থা। দ্বিতীয় ছেলে শরীফ। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন শেকলে বাঁধা। দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে খাবার জোটাবে কে? তৃতীয় ছেলে তরিকুল প্রতিবেশী ফয়জুলের গরু দেখাশোনাসহ কাজ করে দু’বেলা দু’মুঠো আহার জোগায়। ছোট ছেলে শফিকুল নাবালক। ৪ ভাই যে বাড়িতে থাকে, ওই বাড়ির ভিটের জমিটাও নিজেদের নয়। নিহত আশরাফ উদ্দীনের এক বোনের পালিত কন্যার নামে দেয়া। আশরাফ উদ্দীন দু’মেয়ে বিবাহিতা।
কৃষক আশরাফ উদ্দীন খুনের পর গ্রামবাসীর প্রশ্ন অভিযুক্ত প্রভাবশালী খুনি পরিবারের সদস্যদের আদৌ কি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে? এছাড়া খুনের পর আশরাফ উদ্দীনের ছেলেদের সংসারে নেমে আসা চরম অনিশ্চয়তার অবসানে এগিয়ে আসবেন কে?