পরস্পরকে মোকাবিলার কৌশল সাজাচ্ছে বড় দুই দল

স্টাফ রিপোর্টার: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা ও জেলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে রাজনীতির নতুন মেরুকরন চলছে। দুই দলই অগ্রসর হচ্ছে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে। আওয়ামী লীগ সারাদেশে সতর্ক থাকার পাশাপাশি জিয়া পরিবারের দুর্নীতির কথা সারাদেশে জনগণের কাছে তুলে ধরে আগামী নির্বাচনে তাদেরকে বর্জন করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যে এ প্রচারণা শুরুও হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে নির্বাচনী জনসভায় আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যারা এতিমের টাকা মেরে খায় তারা ক্ষমতায় আসলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী ও মার্চের প্রথম সপ্তাহে খুলনায় প্রধানমন্ত্রীর দুটি পৃথক নির্বাচনী জনসভা আছে। সেখানেও খালেদা জিয়া ও তার দলকে আগামী নির্বাচনে বর্জন করার আহ্বান জানানো হবে বলে জানা গেছে।

অপরদিকে, বিএনপি দলের ঐক্য অটুট রাখা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের কর্মসুচীতে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে আরো সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা সফরে যাবেন। পাশাপাশি এখন থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দিবে ২০ দল। গত দুই দিন বৈঠক করে দল ও জোটের নেতারা তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির মধ্য দিয়েই চলমান সংগ্রাম অব্যাহত রাখা হবে। সাথে চলবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও। ২০ দলীয় জোটের ঐক্য অটুট এবং জোটকে আরও সমপ্রসারিত করার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট নেতারা কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সুত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার প্রেক্ষিতে বিএনপি ঘোষিত তিন দিনের মানববন্ধন, অবস্থান  ও অনশন কর্মসূচির পাল্টা কোনো কর্মসূচি দেবে না আওয়ামী লীগ। সারাদেশে সতর্ক থাকবেন তারা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আগুন সন্ত্রাসের পাশাপাশি দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড পাওয়া কোনো দলীয় প্রধানকে নিশ্চয়ই জনগণ পছন্দ করবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের জন্য সতর্কবার্তা। তিনি বলেন, সরকার নয়, এই রায় দিয়েছেন আদালত। আমরা ঠান্ডা মাথায়, সতর্ক ও রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবো।

আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিএনপির ক্ষমতা থাকাকালে প্রধান বিরোধীদল হয়েও কয়েকযুগ ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জেল হত্যার বিচার আমরা পাইনি। আমরা বিচারের জন্য সামান্যতম সহানুভূতি পাইনি। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বিএনপি নেত্রীর কেক কেটে উল্লাস করেছিলেন। এর চেয়ে জঘন্য রাজনীতি আর কী হতে পারে?

খালেদা জিয়ার সাজা ঘোষণার পর চার দিন অতিবাহিত হতে গেলেও এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো আন্দোলন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারায় আওয়ামী লীগে স্বস্তি বিরাজ করছে। অনেকটাই নির্ভার আওয়ামী লীগ। এছাড়া খালেদা জিয়ার শাস্তি ইস্যুতে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনও চাপের মুখে পড়তে হয়নি সরকারকে। খালেদা জিয়ার চারদিন কারাবন্দি থাকার পরও এই ইস্যুতে জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি ছাড়া এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক কোনও চাপ আসেনি বলে দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান। তারা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যতো চাপ এসেছিলো, তার বিন্দুমাত্রও খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আসেনি। এছাড়া বিদেশি গণমাধ্যমগুলো যে সংবাদ পরিবেশন করেছে, তা সরকারের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার সাজার প্রেক্ষিতে বিএনপি আরো দুর্বল হয়ে গেছে এটা ধরে নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি মোকাবেলার দায়িত্ব আপতত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সময় বুঝে কঠোর হতে পারে এমন শঙ্কাও আছে আওয়ামী লীগে। তাই সর্বত্র সজাগ ও সতর্ক আছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে সংযত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে দলটি।

কারাগারে যাওয়ার আগে নেত্রী তার নেতাকর্মীদের ধৈর্য্য ধরতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যা অনেকটাই পালন করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এতে কিছুটা বিস্মিত আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে রাতারাতি বিএনপি চরিত্র বদলে ফেলবে তা মনে করেন না তারা। এ জন্য আরো কিছু সময় দলটির নেতাকর্মীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচন ভন্ডুলের চেষ্টা প্রতিহত করতে সতর্ক আছে ১৪ দল :

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল মাঠে সতর্ক থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আগামী নির্বাচন ভন্ডুলের চেষ্টা রুখে দিতে এখন থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত  সতর্ক থাকবে।

বিএনপির কৌশল জানার চেষ্টা চলছে :

এদিকে খালেদা জিয়া শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথা বললেও তাদের অভ্যন্তরীণ নির্দেশনা কী সেটা আওয়ামী লীগের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের এই কৌশল জানার চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো জনগণের মাঝে গেঁথে গেছে যে, বিএনপির কর্মকান্ড মানেই জ্বালাও-পোড়াও, আগুন সন্ত্রাস, মানুষ হত্যা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা। এ কারণে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি দাঁড়াতেই পারছে না। এ অবস্থায় কোনো ধরনের আন্দোলনের সফলতা তারা পাবে না। তাই তারা সহিংস আন্দোলনে যাচ্ছে না।

আইনি পন্থায় বিএনপি এমনিতেই চাপে থাকবে :

আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, বিএনপির বেহাল অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রস্তুতি আগেভাগেই সম্পন্ন করতে চায়। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ১৫টি টিম সারাদেশে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে। বিএনপি নেত্রীর রায়ের পর ফের এ প্রচারণা জোরালো করার টার্গেট নেয়া হয়েছে।

প্রচারণায় আরো যেসব থাকছে :

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার ছাড়াও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় থাকছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে আগুন সন্ত্রাস, ধ্বংসযজ্ঞ, পুড়িয়ে মানুষ হত্যার চিত্র এবং বর্তমান সরকারের ৯ বছরের অর্জন ও সফলতা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাধিক প্রামাণ্যচিত্র ও গ্রন্থ তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাস এবং হাইকমিশনগুলোতে পাঠানো হয়েছে সেগুলো। জিয়া পরিবারের দুর্নীতির চিত্র সম্বলিত তথ্যও সব জায়গায় পাঠানোর প্রক্রিয়ার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

এদিকে গতকাল ২০ দলীয় জোট ও শনিবার সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে দলের ঐক্য ও সংহতি অটুট রেখে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সবাইকে একতাবদ্ধ থেকে একসুরে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, দল পরিচালনা ও নেতাদের ঐক্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। বিএনপি মনে করে, আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে বেশি-বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হবে। এজন্যই জনসম্পৃক্ত নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দেয়ার বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেছেন।

আজ মানববন্ধন :

বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভুয়া ও জাল নথির মাধ্যমে সাজানো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় সাজা প্রদানের প্রতিবাদে এবং খালেদা জিয়ার নি:শর্ত মুক্তির দাবিতে আজ সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বিএনপি’র উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।

খালেদার মুক্তির দাবিতে ভবিষ্যতে ২০ দলের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি :

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০-দলীয় জোট। একই সঙ্গে বিএনপির বর্তমান কর্মসূচিতে জোটের দলগুলো একাত্মতা পোষণ করেছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গতকাল রোববার বিকেল ২০-দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এছাড়া ২০-দলীয় জোটের ঐক্য অটুট এবং জোটকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট নেতারা কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও জানান বিএনপি মহাসচিব।

বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বক্তব্য রেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তার আহ্বান যেটা এসেছে- জনগণের জোট তৈরি করার জন্য একটা প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে। খালেদা জিয়া শেষ সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। জোটের নেতারা তার ওই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। জোটের সবক’টি দলকে কাজ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।’ জোটনেত্রী কারাগারে, সেক্ষেত্রে জোটের প্রধান কে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেগম জিয়া কারাগারে থাকুন বা যেখানেই থাকুন তিনিই জোটের নেত্রী, তিনিই ২০ দলের নেত্রী। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সমন্বয়ক হিসেবে আমি কাজ করেছিলাম, এখনো করছি।’