নিহতদের পরিবারের হাতে ১০ ও আহতদের ৫ হাজার টাকায় হলো রফা : চালক ও হেলপার জেলহাজতে

দামুড়হুদার জয়রামপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩ ও আহত ১২ ঘটনার আপস
দর্শনা অফিস: বছর না ঘুরতেই স্মরণকালের ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের চালক এবং হেলপারের আপস রফার ঘটনা ঘটলো। সামান্য অর্থের বিনিময়ে হলো নিষ্পত্তি। ঘাতক ট্রাকচালক ও হেলপার রয়েছে জেলহাজতে। ব্যাপক আলোচিত দুর্ঘটনার বিষয়টি আপস রফাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানামুখি গুঞ্জন। ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ দামুড়হুদার জয়রামপুরে ঘটেছিলো স্মরণকালের ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। একই গ্রামের ১৩ জনের মৃত্যু ও ১২ জন আহতের ঘটনাটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। গত বছরের ২৬ মার্চ সকালে আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জের রাস্তা নির্মাণ কাজের উদ্দেশে প্রতিদিনের মতো ২৪জন শ্রমিক নিয়ে স্বাভাবিক গতিতেই আলমসাধুটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন দামুড়হুদার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের বড়বলদিয়া গ্রামের গাজি। আলমসাধুটি যখন চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সড়কের দামুড়হুদার হাউলী ইউনিয়নের জয়রামপুর স্কুল বটতলা নামকস্থানে পৌঁছায়, ঠিক তখনি বিপরীত দিক থেকে সিলেটি বালি ভর্তি দ্রুতগতিতে আসা যন্ত্রদানব ঘাতক ট্রাক (চুয়াডাঙ্গা-ট-১১-০৫৮৮) সজোরো মুখোমুখি ধাক্কা দেয় শ্রমিক ভর্তি আলমসাধুতে। এ ধাক্কায় আলসসাধু দুমড়ে মুচড়ে ল-ভ-ভাবে ছিটকে পড়ে ২৪ জন শ্রমিকসহ চালক। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ও পিচ রাস্তায় আচড়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ৮ জন। হাসপাতালে নেয়ার পথে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ১২ জন। ভয়াবহ এ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হয়েছিলো দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের বড়বলদিয়া পশ্চিমপাড়ার ইন্নাল ম-লের ছেলে ২ সন্তানের জনক আকব্বর (৫০), ঠা-ু ম-লের ছেলে ২ সন্তানের জনক বিল্ল¬াল হোসেন (৩৫), ফকির চাঁদের ছেলে ২ সন্তানের জনক লাল মিয়া (৪০), নাসির উদ্দিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম (২২), কালু (১৯), আহসান বিশ্বাসের ছেলে শরিফুল (৪০), নিয়ামত আলীর ছেলে জিয়াউর রহমান (৩৮) আব্দুল জলিলের ছেলে আতিকুল (৩৫) মাঝপাড়ার কিতাব আলীর ছেলে ৩ সন্তানের জনক নজির আহম্মেদ (৪৫), খোদা বক্সের ছেলে ২ সন্তানের জনক জজ মিয়া (৩২), ভোলাই ম-লের ছেলে ১ সন্তানের জনক বিল¬াল হোসেন (৪৫), বাবুল হোসেনের ছেলে ২ সন্তানের জনক হাফিজুল (৩৫), ফরজ আলীর ছেলে তরিকুল (২৮), কিতাব আলীর ছেলে সোহরাব (৫০), মিনাজ উদ্দিনের ছেলে আলী হোসেন (৫২) আজান আলীর ছেলে আলতাফ (৪০), আমদ আলীর ছেলে নুরুল (৫৫), লুৎফরের ছেলে গাজি মিয়া (৪০) খালপাড়ার গাজি মিয়ার ছেলে আলমসাধু চালক শান্ত (২৫), লিয়াকত আলীর ছেলে শাহীন (২০), রমজান আলীর ছেলে ৩ সন্তানের জনক রফিকুল (৫৫), গোলাম রহমানের ছেলে ২ সন্তানের জনক ইজ্জত আলী (৫৫) ও সুলতানপুরের ফিরোজ আলীর ছেলে ১ সন্তানের জনক শফিকুল (২৭)। ঘটনাটি গোটা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। হৃদয়বিদারক এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া ছিলো কয়েক মাস ধরে। ঘটনার রাতেই দামুড়হুদা মডেল থানার উপপরিদর্শক মেজবাহুর রহমান বাদী হয়ে ট্রাকচালক রাজিব ও হেলপার জুয়েলকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর থেকেই রাজিব ও জুয়েল ছিলো পালাতক। নিহত ও আহত পরিবারের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান, বিত্তবানসহ সরকারি-বেসরকাবি বিভিন্ন সংস্থা।
জানা গেছে, কয়েক মাস ধরেই সাহায্য প্রদান ছিলো অব্যাহত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ত্রাণ সামগ্রী আনার ফলে গঠন করা হয়েছিলো ত্রাণ কমিটি। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন, ইউপি সদস্য হযরত আলী ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। ফলে ১৩ জন নিহতের প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা নগদ টাকা, গরু, ছাগল, চাল, ডাল, পোশাক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ প্রায় ৭ লাখ টাকার বিভিন্ন উপকরণ পেয়েছে। ১২ জন আহতদের পরিবারের সদস্যরা পেয়েছে প্রায় ৪ লাখ করে টাকা। ঘটনার ৮ মাসের মাথায় ট্রাকের হেলপার জুয়েল রানা আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সে থেকেই জুয়েল রয়েছে জেলহাজতে। দীর্ঘ ৮ মাস তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দামুড়হুদা থানার এসআই আমজাদ হোসেন ৩০ অক্টোবর রাজিব ও জুয়েলকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২৬ নভেম্বর চার্জশিট গ্রহণ করে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১৫ জানুয়ারি সোমবার চালক রাজিব আদালতে আত্মসমর্পণ করে। আদালত রাজিবের জামিন না মঞ্জুর করে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
এ দিকে রাজিব আত্মসমর্পণ করার ২ দিন আগে ১৩ জানুয়ারি শনিবার বিকেলে দর্শনায় দ’ুপক্ষ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে আপস বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে নিহত ১৩ জনের মধ্যে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার করে ও আহতদের পরিবারের মধ্যে ৫ হাজার করে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া আলমসাধু বাবদ ১৫ হাজার টাকা দেয়ার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়। সর্বমোট ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনা আপস সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেকের কাছেই হয়েছে প্রশ্নবৃদ্ধ। গতকাল মঙ্গলবার আপসনামা দু’পক্ষের আইনজীবীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।