সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদেরই

সড়ক দুর্ঘটনার হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরকারের নানা উদ্যোগও যখন দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সম্প্রতি এক তথ্যে জানা যায়, শুধু ২০১৭ সালেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এ সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে ১ হাজার ৭২২ জনকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আহত হয়েছেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন। গত বছর দেশে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে ৪ হাজার ৯৭৯টি। জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য মনিটরিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসা সড়ক দুর্ঘটনার উদ্বেগজনক এ তথ্য সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সড়ক দুর্ঘটনা এক বীভৎস পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের দেশে। প্রতিনিয়তই দেশের কোনো না কোনো স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে সংশ্লিষ্টরা যেন বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমেই তাদের কর্মকা- চালু রেখেছেন। দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করে তা প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ সুপারিশ অনুযায়ী সরকার উদ্যোগ নিলেও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক অভারটেকিং, অদক্ষ চালককে যানবাহন চালানো থেকে বিরত রাখা যায়নি। এছাড়া রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ ত্রুটির কথা বলাই বাহুল্য। দিন দিন ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, একই সঙ্গে যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে পড়া, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকায় রাস্তার মাঝপথে পথচারীদের যাতায়াতের ফলেও সড়ক দুর্ঘটনার বাড়ছে। এ পরিস্থিতি জনগণের মাঝে আতঙ্ক বহুলাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এর আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। এবার বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ। এটি কতো ভয়াবহ তা এই চিত্র থেকেও স্পষ্ট। তাছাড়া একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি দুর্ঘটনায় মারা যান কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করেন তাহলে ওই পরিবারটি নিঃসন্দেহে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই ঢলে পড়ে-বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়া কর্তব্য। আর এতোসব দুঃখজনক বাস্তবতা জানার পরও যদি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ না হয় কিংবা সরকারের উদ্যোগ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে তা অত্যন্ত পরিতাপেরই জন্ম দেয়। সংবাদ সম্মেলনে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। পাশাপাশি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাটবাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন, জের্বাক্রসিং অঙ্কন, চালকদের প্রফেশনাল ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেয়ার পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করারও সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ পর্যন্ত কম কথা বলা হয়নি। সরকারের উদ্যোগও আছে, এরপরও যখন তা কোনো কাজে আসছে না তখন ‘গলদ’ খুঁজে বের করে তা নিরসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদেরই। দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টরা অনেক সময় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না। সংশ্লিষ্টদের এমন ‘নতজানুনীতি প্রদর্শন’ কাম্য হতে পারে না। সম্প্রতি দুর্ঘটনার যে চিত্র উঠে এসেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। ২০১৭ সালে যখন গত বছরের চেয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে- তখন এর দায় কে নেবে- এমন প্রশ্নও অমূলক হতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্টদের কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই, তা সাম্প্রতিক তথ্য চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার এমন উদ্যোগ গ্রহণ করবে যা সত্যিকার অর্থেই দুর্ঘটনা নিরসনে কার্যকর হবে। সড়কে বীভৎস এই মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ববরণ কারও প্রত্যাশা হতে পারে না।