হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি পরতেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতিফলন : ফুলও ছড়াচ্ছে সুবাস

পরিষ্কার পরিছন্ন পরিবেশে খুলনা বিভাগে চুয়াডাঙ্গা প্রথম হওয়ার স্বীকৃতিই শুধু নয় স্থাপন হতে চলেছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

আহসান আলম/সাইফ জাহান: না, এখন আর নাকে রোমাল কিংবা শাড়ির আঁচল চেপে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে প্রবেশ করতে হয় না। পরিবেশ পাল্টে বারান্দার ফুলবাগানের গাছগুলোতেও ফুল ফুটে ছড়াতে শুরু করেছে সুবাস। দৃশ্য দেখে যে কেউই বলতে বাধ্য, পরিষ্কার পরিছন্নতায় এবার খুলনা বিভাগের শীর্ষে থাকা চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি এবার দেশের শীর্ষ স্থানের স্বীকৃতি পেতে বাধ্য। আর লোকবলের সঙ্কট যদি কাটিয়ে উঠতে পারতো তাহলে চিকিৎসা সেবার মানেও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি হতো অনন্য এক উদাহরণ। গড়ে উঠতো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি একযুগেরও বেশি সময় আগে ১শ শয্যায় উন্নিত হলেও লোকবল সেই ৫০ শয্যারই। তাতেও রয়েছে ঘাটতি। এদিকে চলতি বছরেই হাসপাতলটি আড়াই শ’ শয্যায় উন্নিত হবে। সে লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ৮ তলাবিশিষ্ট বিশাল ভবন ৬তলা পর্যন্ত আপাতত নির্মাণ করা হবে। যার নির্মাণ কাজ চলতি বছরের জুনের আগেই সম্পন্ন হওয়ার কথা। এ অবকাঠামো নির্মাণ শেষে আড়াই শ’ শয্যার হাসপাতাল চালু হলে চিকিৎসা সেবার মানটাই বদলে যাবে। কথায় কথায় রোগী রেফার যেমন করার সুযোগ থাকবে না তেমনই থাকবে ডায়গোনসিস তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষার যাবতীয় আয়োজন। ইনটেনসিব কেয়ারও থাকবে এ হাসপাতালে। ফলে আড়াই শ’ শয্যায় উন্নিত হওয়া হাসপতালের পূর্ণতা দেখার অপেক্ষায় এখন উন্নয়নকামী চুয়াডাঙ্গাবাসী। একই সাথে হাসপাতালের বর্তমান দৃশ্যপট দেখেও স্বাস্থ্য সচেতন মহলে জেগেছে আশার আলো। গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আরও একটি নতুন অ্যাম্বুলেন্স যুক্ত হয়েছে। হাসপাতাল চত্ত্বরের যতো অবৈধ স্থাপনা ছিলো তার সবই গতকাল বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি গতবছর খুলনা বিভাগের মধ্যে পরিষ্কার পরিছন্নতায় প্রথম স্থানে ছিলো। দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানের স্বীকৃতি লাভ করে। যা সম্ভব হয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর মডেল হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি ও পৌরসভা থেকে সরবরাহকৃত পরিষ্কার পরিছন্নকর্মী নিযুক্ত করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে হাসপাতালের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত করা ও রাখার প্রয়াস। যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন। সেই ধারাবাহিকতা শুধু ধরেই রাখেননি, বর্তমান মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন আনলেও লোকবলের মধ্যে পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজে এনেছেন সুপ্ত প্রতিযোগিতা। এ কাজকে আরও তরান্বিত করেছে চুয়াডাঙ্গা সদর মডেল হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি। এ কমিটি প্রবর্তক তথা শীর্ষ নির্দেশক চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। এছাড়া জামান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যেমন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, তেমনই বঙ্গজ তাল্লু গ্রুপের চেয়ারম্যানও প্রতিশ্রুতি মতো পরিষ্কার পরিছন্ন কর্মীদের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকবলের বেতন দিচ্ছেন। দিচ্ছেন পরিষ্কার পরিছন্ন কাজে ব্যবহৃত দ্রব্য সামগ্রী। ডায়ম- ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুধু জরুরি বিভাগের আইপিএসই নয়, পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ইট পেতে ও ফুলের বাগান ঘেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ দিচ্ছেন হুইল চেয়ার, কেউ দিচ্ছেন বৈদ্যুতিক পাখাসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু। হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ধরণ দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে চিকিৎসা সেবা দেয়ার মানসিকতা। এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরও হাসপাতালের চেম্বারে পাওয়া যায়। এজন্য অবশ্য চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলমের আন্তরিকতার স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়া আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামীম কবিরের সার্বক্ষণিক তদারকিতে পরিষ্কার পরিছন্ন কর্র্মীদের মধ্যে শুধু কর্মউদ্দীপনায় গড়েনি, হাসপাতালের বারান্দায় ক’দিন আগে লাগানো ফুলগাছগুলোতে ফুলও ফুটতে শুরু করেছে। তাতেও ছড়াচ্ছে সুবাস।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল চত্ত্বরে গোলকরে ঘেরা ফুলবাগান ও রবার গাছটির পাদদেশ টাইলস দিয়ে চকচকে করার কাজ শুরু হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর মডেল হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি এ কাজের উদ্যোগ নিয়েছে। এ কমিটির তরফে ৮ জন পরিছন্নকর্মী কাজ করে। বঙ্গজ তাল্লু গ্রুপ বেতন দেয় ১০ জনের। আর পৌরসভা থেকে দেয়া হয়েছে ৯ জন পরিছন্ন কর্মী। এদের পরিচালনার জন্য একজন করে দুজন সুপারভাইজার ও তদারকির দায়িত্ব পালন করেন আরএমও। হাসপাতালের বহির্বিভাগের পাশাপাশি বিশেষ উদ্যোগে চালু করা ডায়রিয়া ওয়ার্ডটি মডেল বাস্তবায়ন কমিটি নিযুক্ত পরিছন্ন কর্মীরা পরিষ্কার পরিছন্ন কাজ করে। আর আন্তঃবিভাগের ওয়ার্ডগুলো পৌরসভার নিযুক্ত লোকবল দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন। এতেই হাসপাতালের পরিবেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে। পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে জামান গ্রুপের তরফে ডাস্টবিন দেয়ার পাশাপাশি বসার চেয়ারও দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেরই অভিমত, পরিবেশ উন্নতি করার পাশাপাশি লোকবলের ঘাটতি কাটাতে পারলে চুয়াডাঙ্গার স্বাস্থ্য সেবার মান দেশের মধ্যে অনুকরণীয় করে তোলা সম্ভব। সদর হাসপাতালে মঞ্জুরিকৃত ১৩৫টি পদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ২১টি পদ শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্স ৫৪পদের মধ্যে ৪টি পদ শূন্য। সিনিয়র চক্ষু কনসালটেন্ট পদটি জুনিয়র কনসালটেন্ট পুরণ করেছেন। সিনিয়র মেডিসিন কনসালটেন্ট পদটি সিনিয়র কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট দিয়ে চালানো হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটিতে জরুরি বিভাগে চিকিৎসক পদ নেই। মেডিকেল অফিসারদের দিয়ে জরুরি বিভাগটি চালানো হয়। যার ফলে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবাই চিকিৎসক সঙ্কটের বিষয়টি ফুটে ওঠে। লোকবল সঙ্কট থাকার কারণে জরুরি বিভাগে ১৩ জন স্বেচ্ছাসেবি কাজ করেন। আন্তঃবিভাগেও স্বেচ্ছাসেবির সংখ্যা ১১ জন। মডেল হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির তরফে ১২টি সিলিং ফ্যানসহ পানীয় পানির জন্য ৬টি ফিল্টারও দিয়েছে। ছিঁচকে চোরের উৎপাত বন্ধসহ সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ মোতায়েনও করা হয়েছে। দালাল রুখতে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করে প্রশাসন। সব মিলিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি হতে চলেছে অনন্য উদাহারণ। যদিও অনেকের মনেই শঙ্কা, কে জানে কতক্ষণ থাকে সম্মিলিত এ প্রচেষ্টা।

Leave a comment