ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহব্যাপী শ’শ’ গ্রেফতার, একাধিক ব্যক্তিকে নিখোঁজের পর গ্রেফতার দেখানো ও জঙ্গি দমন অভিযান ছিলো ২০১৭ সালে জেলার আলোচিত ঘটনা। বছর জুড়েই ছিলো সাধারণ মানুষের মাঝে চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। কে কখন শাদা পোশাকধারীদের দ্বারা গুম হয় এ ভয়ে মানুষ তটস্থ ছিলো। বছর শেষেও সেই উৎকন্ঠার অবসান ঘটেনি। এছাড়া জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় পুলিশ কয়েক হাজার আসামিকে গ্রেফতার করে। উদ্ধার হয় মাদক ও দেশি-বিদেশী অস্ত্র। ২০১৭ সালে ঝিনাইদহে বড় ধরনের মাদকবিরোধী সমাবেশ করে পুলিশ চমক দেখায়। সেখানে জেলার দাগী ও চিহ্নিত ৭১জন মাদক বিক্রেতা ও ৮৭২জন মাদকসেবী আত্মসমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা সন্তোষজনক হলেও শাদা পোশাকে তুলে নিয়ে টাকা আদায়ের ফলে নিরীহ ও নিরাপরাধ মানুষ বেকায়দায় পড়ে। কোনো কোনো উপজেলায় বছর শেষেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে ২০১৭ সালে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, র্যাব ও পুলিশের অভিযানে মহেশপুরের বজরাপুর গ্রামে নিহত হয় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের চৈতি বাউলের ছেলে নওমুসলিম আব্দুল্লাহ (৩৮) ওরফে প্রভাত ওরফে বেড়ে ও একই উপজেলার ধানহাড়িয়া গ্রামের আত্তাপ ওরফে আতা ড্রাইভারের ছেলে তুহিন (২৬)। এরা জঙ্গির সাথে সংশ্লিষ্ট বলে দাবি করে পুলিশ ও র্যাব। এছাড়া পোড়াহাটি, লেবুতলা, ধানহাড়িয়া ও মহেশপুরের বজরাপুর জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকদ্রব্য, ইলেকট্রিক ডিভাইস, বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, মোটরসাইকেল ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। ওই বাড়িটি ছিলো নওমুসলিম আব্দুল্লাহ’র। দু’দিনব্যাপী অভিযান শেষে সেখান থেকে ২০টি রাসায়নিক কনটেইনার, সুইসাইডাল বেল্ট ৯টি, একটি প্রেসার কুকার বোম, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ৮-১০টি মাইন সাদৃশ্য বস্তু, প্রচুর পরিমাণে ইলেক্ট্রিক সার্কিট, ১শ’ প্যাকেট লোহার ছোট বল, ১৫টি জেহাদি বই, ৭ রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল ও একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়। ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ৭জন বোমা নিষ্ক্রিয়কারীসহ ৩০জন সদস্য, খুলনা রেঞ্জ পুলিশ, ঝিনাইদহ পুলিশ, এলআইসি ও পিবিআই টিমসহ ৪শ’ সদস্য এ অভিযানে অংশ নেন। অভিযানকালে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অভিযানে টেররিজম ইউনিটের এডিসি নাজমুল, বোমা ডিসপোজালের এডিসি রহমত ও ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান অংশ নেন। গত ৭ মে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার লেবুতলা ও মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর গ্রামে পৃথক দু’টি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটি। প্রচ- গোলাগুলির এক পর্যায়ে মহেশপুরের বজরাপুরে নিহত হয় তুহিন ও আব্দুল্লাহ। পুলিশের ভাষ্যমতে ঘরের ভেতরে সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতি হয় জঙ্গিরা। পরে বাড়ির মালিক জহিরুল ইসলাম ও তার ছেলে জসিমকে পুলিশ আটক করে। একই দিনে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার লেবুতলা গ্রামের শরাফত ম-লের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৮টি বোমা ও ১টি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করে। ঘটনাস্থল থেকে শামীম নামের একজনকে আটক করে পুলিশ। ওই বাড়িটি জঙ্গিদের নিরাপদ ঘাঁটি ছিলো বলে সে সময় পুলিশ দাবি করে। একই বছরের ১৬ মে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ধানহাড়িয়া গ্রামে সন্দেহভাজন দু’টি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালিয়ে র্যাবের বোমা ডিসপোজাল ইউনিট সক্রিয় দু’টি সুইসাইডাল ভেস্ট ও ৪টি বোমা উদ্ধার করে। সেলিম ও প্রান্ত নামে নব্য জেএমবি’র ২ সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক এ অভিযান চালানো হয়। র্যাব বিদায়ী বছরে জঙ্গি তামিম-সরোয়ার গ্রুপের প্রায় ১০-১২জন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এদিকে জঙ্গি দমন অভিযানের খবর মিডিয়ায় লাইভ প্রচার হলে জেলাব্যাপী বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। জঙ্গি দমন অভিযানের মাঝেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে মাদরাসার ছাত্র, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, বিএনপি, ছাত্রদল এমনকি সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও নিখোঁজ হতে থাকে। একের পর এক বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বীকারের ফলে পরিবারগুলোতে আতঙ্ক দেখা দেয়। পরে অবশ্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী সন্দেহে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এখনো কোটচাঁদপুরের হরিনদিয়া গ্রামের সাজেদুর রহমান ও তার ছোট ভাই মাকছুদুর রহমান রানা গুম হয়ে আছেন। তাদেরকে এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।