সবার দৃষ্টি রংপুর সিটি নির্বাচনে : আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ জাতীয় পার্টির

সার্বিক পরিস্থিতি ইসির অনুকূলে : সিইসি, উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রিপক্ষীয় লড়াইয়ের আভাস : তিন দলের অংশগ্রহণে অগ্নিপরীক্ষায় কমিশন

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে ভোট মানেই উৎসব। সেই উৎসবমুখর পরিবেশেই আজ রংপুর সিটি কর্পোরেশনে (রসিক) সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। সারা দেশের নজর রংপুরের দিকে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ভোটের সরঞ্জাম। স্থানীয় নির্বাচন হলেও প্রচারে কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণে বইছে জাতীয় নির্বাচনের আবহ। প্রায় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ভোটার আজ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করবেন তাদের নগরপিতা। চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে শেষ হবে বিকেল ৪টায়। ভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে আশাবাদী নির্বাচন কমিশন। গতকাল বুধবার বিকেল ঢাকার আগারগাঁওয়ে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, ভোটের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে এবং সার্বিক পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৮টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাড়ে পাঁচ হাজার নিরাপত্তাকর্মী নামানো হয়েছে মাঠে। ২০৩ বর্গকিলোমিটারের এ সিটিতে নারী ও পুরুষ ভোটার প্রায় সমান সমান। গত মঙ্গলবার সকাল থেকেই মাঠে বিজিবির টহল শুরু হয়েছে। একটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেয়া হবে। সিসি ক্যামেরা থাকবে তিনটি কেন্দ্রে। মেয়র প্রার্থীদের গতকাল বুধবার নিজ নিজ বাসায় দলের নেতাদের সঙ্গে শেষ মুহূর্তের কৌশল নির্ধারণ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। দীর্ঘ নয় বছর পর রংপুর অঞ্চলে দলীয় প্রতীক নিয়ে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা, বিএনপির ধানের শীষ ও জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। মেয়র পদে মোট প্রার্থী সাতজন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বড় তিন দলের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন ইসির জন্য অগ্নিপরীক্ষা। তবে শেষ মুহূর্তে ভোটের প্রস্তুতি কেমন হবে তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে কিঞ্চিত শঙ্কা থাকছেই। বিএনপি প্রার্থীও এই শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বলছেন, ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই।
নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষায় পাস করতে স্থানীয়ভাবে দলগুলো ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ভোট গ্রহণ ও গণনা পর্যন্ত কেন্দ্রে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতারা। কোনো ধরনের সহিংসতায় না জড়াতেও বলা হয়েছে। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই, আছে উত্তাপ ও উত্তেজনা। প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির কিছু অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শতভাগ আশাবাদী।

রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ দীর্ঘদিন ধরেই। এর পাশাপাশি জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর রয়েছে একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। এর পাশাপাশি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইজেম কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছেন মোস্তফা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও চেষ্টা করেছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে। বিএনপি এ নির্বাচনকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখছে। নির্বাচনে জয় পেলে দলটি সরকারের তীব্র সমালোচনার সুযোগ পাবে। আর পরাজিত হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে-এমন শঙ্কা ব্যক্ত করছেন স্থানীয় রাজনীতিকদের কেউ কেউ।

তবে ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণে নির্বাচন কমিশন সচেষ্ট রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকল বুধবার রাতে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, রংপুর সিটি কর্পোরেশনে মডেল নির্বাচন করতে চাই। এ নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেট তৎপর রয়েছেন। আচরণবিধি লংঘনে তাৎক্ষণিক মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। আ.লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা (ইসি) বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা এক ও একাধিকবার নির্বাচনী এলাকা সফর করে সার্বিক বিষয় মনিটরিং করছেন। আমাদের বিশ্বাস এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে। রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেছেন। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘ্ন ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন।

গতকাল কথা হয় রংপুরের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার জিএম সাহাতাব উদ্দিনের সঙ্গে। ভোট গ্রহণের জন্য সব কেন্দ্রে নির্বাচনী মালামাল পৌঁছে গেছে। ভোটের আগের রাতে টাকা ছড়াছড়ি বন্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের টহল বাড়ানো হয়েছে। তিনি জানান, ভোটারদের নিরাপত্তায় মাঠে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্য। এছাড়া রিজার্ভ ফোর্স রয়েছে দেড় হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে সাত হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে চার স্তরের নিরাপত্তা বলয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, শহরের অলিগলিতে, চায়ের দোকানে, অফিসে সর্বত্রই রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। তাদের কৌতূহল কে হচ্ছেন নগরপিতা? গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একজন তরুণ ও নতুন ভোটার বলেন, হ্যামাক এলাকার ভালো কাজ করবে, হ্যামারগুলার সুখ-দুঃখ দেখপে তাকে হ্যামরা ভোট দিমু। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও অনেকে। জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, শুধু মহানগরী নয়, রংপুর অঞ্চল জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। রংপুর-৩ (সদর) আসনের এমপি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ। এসব কারণে এ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হওয়া দলের ইমেজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলটির একাধিক নেতা জানান, জাতীয় পার্টির বিপুল জনপ্রিয়তা ছাড়াও মেয়র প্রার্থী মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার ব্যক্তি ইমেজ জয়ের ক্ষেত্রে কাজ করবে। ২০১২ সালে প্রথম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একই দলের দু’জন প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও মেয়র পদে দলীয় প্রতীক ছাড়াই ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন মোস্তফা। ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দীন। এবার সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিবেচনায় অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী সবদিক থেকেই এগিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও দলের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী সমন্বয়ক এসএম ইয়াছির বলেন, আমাদের স্যার (এইচএম এরশাদ) সব দিক বিবেচনা করে মোস্তফাকে মেয়র প্রার্থী করেছেন। দলের জনপ্রিয়তা বেশি ও তার ইমেজও অনেক ভালো। এসব বিবেচনায় ভোটাররা আমাদের প্রার্থীকে বেছে নেবেন। তিনি বলেন, ভোট গ্রহণের সময় দলের নেতাকর্মীদের নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান করতে বলেছি। তবে কেউ কারচুপির চেষ্টা করলে সহিংসতা এড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা হবে।

অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ব্যাজ পরে ভোট কেন্দ্রের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সহায়তা করতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে রংপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু বলেন, ভোট গ্রহণ থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে অবস্থান ও ফল প্রকাশস্থানে থাকতে বলেছি। নির্বাচনী প্রচারে আমাদের নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে প্রার্থীর ইমেজ নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হতো তা কেটে গেছে। এছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুতনয় সজীব ওয়াজেদ জয়কে রংপুরের পীরগঞ্জ আসনে প্রার্থী হিসেবে আমরা দেখতে চাই। তাই সিটি নির্বাচনে জয়লাভ আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া বিএনপি রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হোসেন  বলেন, ভোটের মাঠে আমরা ছিলাম, আছি ও থাকব। সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণ এখন বিএনপিকে ভোট দিতে মুখিয়ে রয়েছে। তবে সুষ্ঠু ভোট হবে কিনা- তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতা ইতোমধ্যে বলেছেন, এ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর অবস্থান হবে তিন নম্বরে। ভোটের আগে তাদের এ বক্তব্য কারচুপির আগাম শঙ্কা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ভোটে কারচুপি করা হলে আমাদের নেতাকর্মীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ জানাবে। তারা সহিংসতায় জড়াবে না।