প্রসঙ্গ: জীবনযুদ্ধে জয় পরাজয় এবং দীর্ঘশ্বাস

প্রত্যেকের হাতের আঙুলের রেখাগুলো যেমন ভিন্ন, তেমনই অবয়বেও ভিন্নতা স্পষ্ট। প্রত্যেকের জীবনযুদ্ধের রকমফেরেও নেই ন্যূনতম মিল। তা না হলে চুয়াডাঙ্গার পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তের দুটি গ্রামের দুজন পিতার জীবনযুদ্ধের জয় পরাজয়ের আংশিক ছবি গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় উঠে এসেছে। দুজন পিতা গাড়াবাড়িয়া মসজিদপাড়ার মহিদুল ইসলাম ও দৌলাতদিয়াড় বঙ্গজপাড়ার ফজলুর রহমান জীবন সম্পর্কে বুঝতে না বুঝতেই নামতে হয় রোজগারের পথে। প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যখন ন্যূনতম স্বস্তির শ্বাস ছাড়ার সুযোগ পেতেন তখনই স্বপ্ন দেখতেন সন্তানই দূর করবে তাদের কষ্ট। এ স্বপ্ন নিশ্চয় অমূলক নয়। কেননা, এক ছেলেই একটি সংসারের জন্য যেমন বয়ে আনতে পারে আশীর্বাদ, তেমনই একজন কুসন্তানই যথেষ্ট সব কিছু তছনছের জন্য।
বাস্তবতা সত্যিই বড্ড কঠিন। মহিদুল ইসলাম তার জবানিতে বলেছেন, জীবনের শুরুতে বুঝিনি, বাপ তার অন্য ছেলেদের লেখাপড়া করতে দিয়ে আমাকে পাঠালো মাঠে। সেই যে শুরু হলো পরিশ্রম, আর থামলো না। লেখাপড়া শিখে ভাইয়েরা নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করলো, আমাকে হতে হলো দিনমজুর। দীর্ঘদিন ধরে দিনমজুরি করে ৩ মেয়ে ও ২ ছেলের সংসার টেনে বড্ড ক্লান্ত। এক ছেলে প্রতিবন্ধী হলেও অপর ছেলে ধারকর্জ করে সাত মাস আগে মালয়েশিয়ায় গেছে। সেখানে পরিশ্রম করে টাকাও পাঠাচ্ছে। ধারকর্জ পরিশোধ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে পারলে আর দিনমজুরি করতে হবে না। দিনমজুরির জন্য চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বরে রাস্তার পাশে অপেক্ষায় থাকাকালেই এসব তথ্য দিয়ে বলেন, বিগতদিনে যা হয়ে গেছে। যদি ওই প্রতিবন্ধী ছেলেটি না থাকতো তা হলে জীবনের বাকি দিনগুলো ভালোই কাটতো। অপরদিকে অপর যোদ্ধা ফজলুর রহমানের কষ্টটা ভিন্ন। তিনিও ছেলের ওপরেই ভরসা করতে চেয়েছিলেন। জীবনের বেলা শেষে যে সন্তান হবে অবলম্বন, সেই সন্তান যখন নেশাখোর হয়ে সংসারে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে তছনছ করতে শুরু করে তখন নিজের হাতেই নিজের সন্তানকে পুলিশে দিতে হয়েছে। ফজলুর রহমানকে বজারের লেবার হিসেবে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই কুলির কাজ করতে হয়, যে ছেলের ওপর শেষ ভরসা, সেই ছেলেকেই যখন রাখতে হয়েছে নিজের হাতে জেলহাজতে, তখন কষ্টটা কতোটা তীব্র তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না।
শুধু আমাদের সমাজে নয়, বিশ্ব দরবারেও যারা শীর্ষ অর্থশালী, তাদের অধিকাংশকেই নিজের চেষ্টায় ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে হয়েছে। ওদের কারো কারো জীবনযুদ্ধ পর্যালোচনা করলে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা ¯্রােতের উজানে বেয়েই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হয়েছে। অতোটা না হোক, আমাদের সমাজেরও অনেকেই সংসারে স্বচ্ছ্বলতা আনতে পেরেছে। অনেকেই পারেনি। না পারলেও সকলেরই যে একটু স্বস্তি পাওয়ার স্বপ্ন লালন করেন তা বলাই বাহূল্য। পিছিয়ে পড়ার নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে স্বর্বশান্ত হওয়ার উদাহরণ অসংখ্য। তাছাড়া পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রেরও দায় অনেক। পরিকল্পিত পরিশ্রমের সুযোগও যেমন দরকার, তেমনই দরকার পারিবারিক ও সামাজিক সুশিক্ষা। আমাদের সমাজে এর যথেষ্ট ঘাটতি বিদ্যমান।