ডিলারদের কব্জায় ব্যবসা ॥ পোল্ট্রি খামারিদের দুর্দশা

মাজেদুল হক মানিক: উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও মুরগির দরপতনের ফলে মেহেরপুরের পোল্ট্রি খামারিরা ব্যাপক লোকসানের মুখে। বেকার সমস্যা সমাধান এবং আর্থিক উন্নতির জন্য জেলার অনেকেই খামার করেছেন। খামারিদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় বাচ্চা-খাবার উৎপাদনকারী কোম্পানির ডিলারদের দয়ায় চলছে এসব খামার। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও কাঙ্খিত মুনাফা পাচ্ছেন না খামারিরা। অপরদিকে বাজার তদারকি না থাকায় উদীয়মান এ খাত এখন হুমকির মুখে বলে জানালেন খামারিরা।
জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই জেলায় পোল্ট্রি খামারের বিকাশ হচ্ছে। বেকারত্বের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে অনেক যুবক বেছে নিয়েছেন পোল্ট্রি ব্যবসা। ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি পালন করে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। এসব আলোর পথের যাত্রীরা অন্যদের দেখিয়েছেন জীবন জয়ের রঙিন স্বপ্ন। তাদের পথে হেটে কাঙ্খিত পথও পেয়েছেন অনেক বেকার। দরিদ্রতার কষাঘাত থেকে আজ মুক্ত বাতাসে উড়ছেন এসব স্বপ্নচারিণী মানুষগুলো। কিন্তু গত দু’বছর সেই আনন্দের পালে ধাক্কা লেগেছে। সারাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ হলেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাবার ও বাচ্চার দাম। ফলে অনেক খামারির পথে বসার উপক্রম হতে চলেছে। জেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় রয়েছে ৪১০টি ব্রয়লার ও ১২১টি সোনালি মুরগির খামার। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মাংসের চাহিদা ছিলো ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। অবশ্য চাহিদার বেশিরভাগ পূরন হয় গো-মাংস থেকে। তবে পোল্ট্রি খাত থেকে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ চাহিদা মেটে। তাই মাংসের চাহিদা মেটাতে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের জন্য পোল্ট্রি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
কয়েকজন খামারি জানান, এক দিনের ব্রয়লার বাচ্চা ৩৫ দিন পালন করলেই বিক্রি উপযোগী হয়। এতে মুগরি প্রতি ২শ’ টাকার উপরে খরচ হয়। দুই থেকে আড়াই কেজি ওজন হলে তা বিক্রি করা হয়। বর্তমান বাজারের মুরগি বিক্রি করে লাভ তো দুরের থাক বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
খামারি সূত্রে আরও জানা গেছে, বাচ্চা ও খাবার উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর স্থানীয় ডিলার/এজেন্টদের কাছ থেকে এগুলো কিনতে হয়। ডিলাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাকিতে মালামাল সরবরাহ করেন। মুরগি বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করতে হয়। এতে ডিলারদের দর ও অনুগ্রহের উপর নির্ভর করেই মুরগি পালন করতে হচ্ছে। এখাতে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ফলে পুঁজির অভাবে কোম্পানির সাথে সরাসরি বাচ্চা ও খাবার কেনার সুযোগ নেই ছোট খামারিদের।
স্থানীয় বাজার ঘুরে জানা গেছে, প্রতি কেজি ব্রয়লার ১১০-১১৫ টাকা এবং লেয়ার ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার পাইকারী ১০৫ টাকা ও লেয়ার পাইকারী ১৬৫ টাকা। জেলা ছাড়াও পাশর্^বর্তী জেলায় মুরগির উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় দরপতন হচ্ছে। যে পরিমাণ মুরগি বাজারে আসছে তার তুলনায় ক্রেতাও তুলনামূলক কম। তাই কম দামেই মুরগি কিনতে হচ্ছে। দু’বছর আগে ব্রয়লার খুচরা দর ছিলো ১৩০-১৫০ টাকা কেজি। খামারিরা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন পোল্ট্রি হ্যাচারী ও খাদ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। সহজেই হাতের মুঠোয় মিলছে মুরগির বাচ্চা, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। কিন্তু বাচ্চা ও উৎপাদন পণ্যের দর লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৫ বছরে ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে খাবার ও বাচ্চার দর। এতেই খামারিরা ধরাশায়ী হচ্ছে। সরকারিভাবে কোনো পর্যবেক্ষণ না থাকায় ইচ্ছেমত বাড়ে খাবার ও বাচ্চার দর। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই এ খাত মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন খামারিরা। গাংনী ঈদগাহপাড়ার ব্রয়লার খামার মালিক কামিল হোসেন বলেন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন খামার চালাতে পারছি না। এছাড়াও রয়েছে শ্রমিক খরচ। দর কমে যাওয়ায় ব্যাপারিদের অনুরোধ করে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। গত বছর খামার বন্ধ করে এবছর আবার চালু করেছিলাম। কিন্তু আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। খামার বন্ধ হলে অনেক লোক বেকার হবেন বলেও জানান তিনি। জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল আজিজ আল মামুন খামারিদের অভিযোগের বিষয়ে একমত হয়ে বলেন, ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিলার বা এজেন্টদের কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং এর উপর নির্ভরশীল। বাকিতে বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ দেয়। এজেন্টরাই মুরগি বিক্রি করে দেয়। এতে খামারিদের কিছুই থাকে না। যার ফলে এখাতের অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এ খাতে মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের তদারকি থাকা দরকার। সিন্ডিকেটমুক্ত করতে পারলে এ শিল্পে সুবাতাস বয়ে যাওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।