জীবনযুদ্ধে জয় পরাজয়ের খণ্ডচিত্র : বেলা শেষে দীর্ঘশ্বাস

চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন দিনমজুরের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা

আহসান আলম: মানুষ কেন গরিব হয়? শুধুই কি বুদ্ধির ভুল? বৈচিত্রে ভরা জগতে অজ¯্র ভাগ্যহত মানুষের ভিড়ে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে জবাবও বিচিত্র। এদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়িয়া মসজিদপাড়ার মহিদুল, হানুরবাড়াদির ওমর আলী, দৌলাতদিয়াড় বঙ্গজপাড়ার ফজলু, হাড়বাড়াদির রোমেলা খাতুনের ভাগ্যবিড়ম্বনার গভীরেও রকমারি কষ্টের দগদগে ঘা। কেমন আছেন প্রশ্নেই আচমকা অন্যমনষ্ক হয়ে হাতড়ে খোঁজেন জবাব। সত্যিই তো, কেমন আছি আমরা? মহিদুল এখন দিনমজুর হলেও তার অন্যান্য ভাইদের মধ্যে কেউ ব্যাংকার, কেউ সেনাসদস্য, কারো অবস্থান অর্থবৈভবে বিলাশে ভরা। কেন? মধ্যবয়স পেরিয়ে প্রায় পৌঢ়্যতে পৌঁছুনো মহিদুলের জবাব, বাপ ওদের পড়তে দিয়ে আমার পাঠালো মাঠে। ওরা সকলেই সাহেব হলো আমি হলাম দিনমজুর।
সার্ভিস হোল্ডার নাটকে চঞ্চল বড় শহরের সাহেব চরিত্র, তার ভাই বিন্দাবন খেয়ে না খেয়ে পৈত্রিক ভিটেই থাকে পড়ে। অথচ ওই সাহেব হওয়া ভাইকে পড়াতে কতোটাই না কষ্ট করতে হয় বিন্দাবনকে। না, চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়াড়িয়া মসজিদপাড়ার মহিদুল ইসলাম (৬০) অতোটা কষ্টের চিত্র মেলে ধরেননি। কারণ, তার নাকি কষ্টের দিন এখন শেষের দিকে। কেন? মহিদুল ইসলাম বললেন, ‘বড় ছেলেকে ৭ মাস আগে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছি। এখন মাসে মাসে টাকা পাঠায়। ধার কর্যকরা টাকা শোধ হলে আমাকে আর দিনমজুরি করতে হবে না।’ মহিদুল ইসলাম প্রায় প্রতিদিনই প্রভাতে দিনমজুরির কাজের আশায় চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের শহীদ হাসান চত্বরের পদ্মা জুয়েলার্সের সামনে বসে মনিব খোঁজেন। পরশু অনামিকার সামনে বসেই কথা হয় তার সাথে। তিনি যে তথ্য দেন তা শুনে চোখ ওঠে কপালে। ৮ভাইয়ের মধ্যে মহিদুল কেন দিনজমুর তার বর্ণনা অবিশ্বাস্য মনে হতেই গতকাল গাড়াবাড়িয়া মসজিদপড়ায় সরেজমিনে গেলে স্থানীয়দের সাথে মহিদুলের দেয়া বর্ণনার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, পৈত্রিক খুব একটা বেশি জমিজমা না থাকলেও ভাইগুলো লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। এতেই খুশি। আমি দিনমজুরি করলেও কষ্ট ছিলো না, যদি না আমার এক ছেলে প্রতিবন্ধী না হতো।
হানুরবাড়াদি কাজীপাড়ার ওমর আলী (৫৫) দীর্ঘদিন ধরেই দিনমজুরি করেন। দিনমজুরি করতে হয় কেন? শান্তগলায় ওমর আলী বললেন, পৈত্রিকভাবে পাঁচ বিঘা জমি পেলেও তা রাখতে পারিনি। রোগবালাইসহ নানা কারণেই ওই জমি বিক্রি করতে হয়েছে। ৪ ছেলে ৩ মেয়ে। অর্থকষ্টে টানাটানির সংসারেও সন্তান কেন ৭টা হলো? ওমর আলী বললেন, বুঝতে না বুঝতেই তো সন্তান হয়ে গেছে। এক মেয়ে বিয়ে দিতে বাকি থাকলেও ছেলেরা নিজেদের মতো কাজ করে খেতে শিখেছে। কেউ করে দিনমজুরি, কেউ চালায় রিকশা। দিনমজুরি করে সংসার এখন কেমন চলে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওমর আলী বললেন, মাসের ত্রিশদিনই যদি কাজ পেতাম তা হলে আর কষ্ট থাকতো না। এখন দিন হাজরে ৩শ টাকা। সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত কাজ করে চাল ডাল কিনে বাড়ি ফিরে বাড়িওয়ালার (স্ত্রীর) হাসিমুখ দেখা যায়। কিন্তু কাজ তো রোজ মেলে না। মাসে ১৮ থেকে ২০ দিন কাজ হয়। ওই দিয়ে কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলে।
চুয়াডাঙ্গা হাড়বাড়াদির রোমেলা খাতুন দিনমজুর। যখন ৪০ দিনের মাটি কাটা কাজ পান তখন যতোটা স্বাচ্ছন্দে দিন কাটে, অতোটা ভালো থাকে না যখন কাজ থাকে না। গতকাল রোমেলার সাথে যখন কথা হয় তখন তিনি শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের একটি রাস্তায় মাটি কাটার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মাটি কাটতে হচ্ছে কেন? কেনই বা হলেন গরিব? রোমেলা খাতুন বললেন, গরিব হয়েই তো জন্মেছি। গরিব ঘরের মেয়ে হলেও আর দশজন মেয়ের মতো স্বামীর সংসারে সুখী হতে চেয়েছিলাম। এক ছেলে এক মেয়ে রেখে যখন লোকটা চলে গেলো অন্য জায়গায়, তখন ঘরে বসে থাকলে তো আর পেট চলে না।
ফজলু? বয়সের ভারে নূয়ে পড়লেও চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারে কুলিগিরি করতে হয়। সেই ছোটবেলা থেকেই মাথায়, মাজায় কিংবা ঘাড়ে নিয়ে বস্তা বয়ে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। এক ছেলে আর তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ছেলের ওপর ভরসা ছিলো সংসারে ওই স্বচ্ছ্বলতা ফেরাবে। হলো না। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। বাধ্য হয়েই তাকে পুলিশে দিয়েছেন হতদরিদ্র পিতা ফজলুর রহমান ফজলু (৬৫)। গত সোমবার বাজারে বসে কেমন চলছে দিনকাল জিজ্ঞেস করতেই তিনি এসব তথ্য দিয়ে বললেন, ছেলেবেলা থেকেই বাজারের ব্যবসায়ীদের বস্তা বয়ে বেড়াচ্ছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই যে কুলি হলাম, সেই কুলি থেকে আর বের হওয়া হলো না। কুলিগির করে সংসার চালালেও ছেলেটা মানুষ হলে কষ্ট থাকতো না। ওদের দিকে তাকিয়েই তো জীবন যৌবন সবই তো মুটেগিরি করে মাটি করে দিলাম। তিনি বললেন, লেবারের কাজ করি। এ কাজ করেও মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি মাথা উঁচু করে। ছেলেরও বিয়ে দিয়েছিলাম। ঘরে বেটার বউ এলো। এক পুতিও হলো। আর ওই ছেলের বদমাইশি গেলো না। সঙ্গদোষে নেশাখোর হয়ে বাড়িতে যখন অত্যাচার শুরু করলো তখন ধরে বাধ্য হয়েই ওকে দিয়েছি পুলিশে। দীর্ঘদিন ধরেই সে রয়েছে জেলে। আর ছেলের বউ আর ছেলের ছেলেসহ আমার স্ত্রীকে নিয়ে সংসার টেনে টুনে চললেও ছেলেটা ভালো হলে মরেও শান্তি পেতাম।