গুড়-পাটালির কদর বাড়লেও চুয়াডাঙ্গায় হ্রাস পাচ্ছে খেজুরগাছের সংখ্যা
সাইফ জাহান: খেজুরগাছ শুধু মাখালডাঙ্গার রজব আলী কিম্বা বেলগাছির এনামুলেরই ভাগ্য বদল করেনি, চুয়াডাঙ্গা ঝিনাইদহ যশোরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য গাছির সংসারে এনেছে স্বচ্ছলতা। অথচ প্রত্যাশা অনুপাতে বাড়ির আঙিনা কিম্বা আবাদি জমির আইলে এখন আর আগের মতো খেজুরগাছের চারা রোপনই করা হয়। যত্ম আত্মি পরিচর্যা তো পরের কথা। ফলে লাভজনক খেজুরগাছও দিন দিন বিলুপ্তির পথে।
চুয়াডাঙ্গা শহরতলী বেলগাছি গ্রামটি দীর্ঘদিন ধরে শুধু সবুজে ঘেরা পাক-পাখালির নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবেই চিহ্নিত নয়, খেজুরের পাটালির জন্যও বেশ বিশুদ্ধ। সুনাম ধরে রাখতেও পুরাতন গাছিদের আন্তরিকতায় কমতি নেই। তাদের গিন্নিদেরও রস জাল দেয়ার সময় থাকে কড়া নজর। এদেরই একজন এনামুল হক। বয়স পয়তাল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশের কোটায়। তিনি বললেন, বয়স যখন ১১-১৫ তখন থেকেই প্রতি শীতে অন্যের গাছ কেটে রস জ্বালিয়ে পাটালি তৈরি করে বিক্রি করি বাজারে। মালিকদের গাছপতি এখন ১২০ টাকা করে দিতে হয়। আগে অবশ্য কম ছিলো। নগদ এ টাকা আর কিছু পাটালি দিলেই চলে। এতে প্রতিমাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা করে থাকে। এবার লাভের মাত্রা বাড়তে পারে। পাটালির দামটা এবার ভালো। প্রায় ৫ মাস ধরে এ বাণিজ্যে যা জমে তা সংসারের কাজেই লাগে। বেলগাছির অন্যান্য গাছিদের মধ্যে যার সাথেই কথা হয়েছে, তিনিই শুনিয়েছেন খেজুরগাছের রস জালিয়ে প্রতি শীতে কাঁচা টাকা আয়ের কথা। পাশের গ্রাম মাখালডাঙ্গা। এ গ্রামের রজব আলী পাটালি নয়, ভাড়ে ভরে গুড় বিক্রি করেন। তিনি নিজের ১০টিসহ গ্রামের অন্যদের ১০৫টি গাছ ১শ ২০ থেকে দেড়শ টাকা দিয়ে গাছ নিয়ে শীতের ৫ মাস ধরে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা আয় করেন। এবারও একই পরিমাণের আয় হবে বলে দুলোর্ভ ম-লের ছেলে রজব আলীর (৫৫) আশাবাদ।
প্রায় একই সংখ্যক গাছ লিজ নিয়ে কেটে রস জ্বালিয়ে পাটালি করে একজনের আয় ১০ হাজার আর ভাড়ে ভরে গুড় বিক্রি করে রজব আলীর আয় ৩০ হাজার টাকা কেনো? এ রহস্যের ভেদ ভাঙতেই বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গাছি রজব আলী বলেছেন, আমাদের অঞ্চলে বড় গুড়ের হাট সরোজগঞ্জ। এ হাটে ঢাকা, চট্টগ্রাম সিলেটসহ দূরের ব্যাপারীরা আসেন। কিনে নিয়ে যান। হাটের পাশাপাশি কিছু ব্যপারী আছেন যারা আমাদের নিকট থেকেও গুড় কেনেন। ব্যপারীদের অধিকাংশেরই পছন্দ, ভাড়ের মুখে গুড়ের সাদা ফ্যানা। যেটা খেজুরের গুড়ে এমনি এমনি হয় না। চিনি দিতে হয়। বাজারে চিনির দাম ৫৫ টাকা কেজি। আর পাটালি? তাতে চিনির মিশ্রণ ভোক্তারা দেখেই বুঝে হয় বলেন ফিটকিরি না হয় বলেন ভেজাল। কিন্তু গুড়ের ভেলায় ওই চিনি দেয়া গুড়ই বেশি পছন্দ। অবশ্য এলাকার খুচরা ক্রেতা বা ভোক্তাদের ওই চিনি দেয়া গুড় বড্ড অপছন্দ। ফলে স্থানীয় ক্রেতাদের অনেকেই আছেন যারা একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও খেজুরগুড়ের আসল ঘ্রাণ নাকে নিয়েই তা কেনেন।
খেজুরগাছের রসের গুড় শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক স্থানেই সমাদৃত। গুড়-পাটালির দাম বাড়লেও দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে। অথচ এক সময় জমির আইল ঠেলাঠেলি রুখতেও খেঁজুরগাছ লাগিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতেন। আয়ও হতো, জমির আইলও ঠিক থাকতো। অথচ এখন? বদলে গেছে সেই চিত্র। যা আছে তাও বিক্রির হিড়িক যেনো শীতেই লাগে। রস দিয়ে অনেকের সংসারে স্বচ্ছ্বলতা দেয়া গাছগুলো শেষ পর্যন্ত পুড়ে ছাঁই হয় এলাকারই কোনো না কোনো ইটভাটায়।