জহির রায়হান সোহাগ: ৯ বছর বয়সী মেধাবী শিক্ষার্থী জিন্নাতারা। শরীরে কঠিন রোগ নিয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলেও চোখে তার বড় হওয়ার স্বপ্ন। বাবা আক্তার হোসেন ভূমিহীন দিনমজুর। মা সীমা খাতুন গৃহিনী। দামুড়হুদার জয়রামপুর মল্লিকপাড়ার বাসিন্দা আক্তার হোসেনের তিন মেয়ের মধ্যে জিন্নাতারা মেজ। বড় মেয়ে আঁখিতারা খাতুন জয়রামপুর দাখিল মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। জিন্নাতারাও ওই মাদরাসার তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যায়নরত। ছোট মেয়ে খাদেজাতুল কোবরার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। জিন্নাতারা অত্যন্ত মেধাবী। তার বয়স যখন আড়াই মাস তখন শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। তাকে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদনে ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেয়। শুরু হয় চিকিৎসা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক পরিতোষ কুমার ও আবুল হোসেন তার চিকিৎসা করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে হৃৎপি-ে সাধারণত ৪টি ভাল্ব থাকে। দুটি ওপরের চেম্বারে ও দুটি নিচের চেম্বারে। হৃৎপি-ের ভাল্বের সমস্যা অনেক কারণেই হতে পারে। যেমন- জন্মগত ত্রুটি, বাতজ্বর, হৃদযন্ত্রের রক্তনালিতে ব্লক, বার্ধক্যজনিত জটিলতা ইত্যাদি। জন্মগত ত্রুটির মধ্যে রয়েছে ভাল্ব সরু হওয়া, ছিদ্র থাকা ইত্যাদি। তবে ভয়ের কিছু নেই। কেননা, জন্মগত ভাল্বে ত্রুটি শতভাগ সফলতার সাথে চিকিৎসা করা হয় বাংলাদেশে। জন্মগত ত্রুটির কারণে ভাল্ব সরু হলে বেলুনিং করে এবং ছিদ্র থাকলে তা রিপেয়ারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
ওই রোগে আক্রান্ত হওয়া জিন্নাতারার দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর ধরে চিকিৎসা চলে। ওষুধ সেবন করে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও পরে রোগটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। পরে সদর হাসপাতালের চিকিৎসক পরিতোষ কুমার জিন্নাতারার পরিবারকে জানান, কুষ্টিয়া সনো সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন আনতে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর চিকিৎসা দেয়া হবে। খুব কষ্টে কুষ্টিয়া সনো সেন্টার থেকে জিন্নাতারার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এর প্রতিবেদন দেয়া হয় চিকিৎসককে। প্রতিবেদনে ভাল্বের সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসক তখনই তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানে দেখানো হয় ডা. সুব্রত দেবের কাছে। তিনি জানান, অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করতে প্রায় ৬-৭ লাখ টাকা লাগবে। মেয়ের অপারেশনের খরচ শুনে চোখে অন্ধকার দেখেন জিন্নাতারার বাবা-মা। টাকা জোগাড় করতে ফিরে আসেন গ্রামে। গ্রামের লোকজন কিছু টাকা জোগাড় করে। সদর হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবুর রহমান মিলনও আর্থিক সহায়তা করেন। কিন্তু তাতে চিকিৎসার টাকা পুরো জোগার হয়নি। জিন্নাতারার বাবা-মার মুখে হতাশার ছাপ। তাহলে কি মেয়ের চিকিৎসা হবে না? মেয়ের বড় হওয়ার স্বপ্ন কি অঙ্কুরে বিনষ্ট হবে? মেয়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে বিভিন্ন মহলে মহলে কড়া নাড়েন বাবা আক্তার। তাতেও খুব একটা সাঁড়া মেলেনি। পরে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীনের কাছে মেয়ের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা চান জিন্নাতারার বাবা-মা। জেলা প্রশাসক জিন্নাতারার চিকিৎসার জন্য ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তাই শুধু দেননি, আশার আলো জ্বেলেছেন হতাশাগ্রস্ত অসহায় দিন মজুরের পরিবারে। জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের খ্যাতিমান চিকিৎসক ফয়েজুল ইসলাম। তিনি ওই হাসপাতালের হার্ট, রক্ষনালি ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ সার্জন। তাকে অসহায় পরিবারে জন্ম নেয়া জিন্নাতারার রোগের কথা বলেন জেলা প্রশাসক। ডা. ফয়েজুল ইসলাম বিনামূল্যে তার অপারেশন ও চিকিৎসার ভার নেন। তিনি নিউরো বাংলা হার্ট নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে জিন্নাতারার অপারেশন করেন। বিশেষ কারণে তার দু’বার অপারেশন করা হয়। বর্তমানে মেধাবী জিন্নাতারা সম্পূর্ণ সুস্থ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সুস্থ মেয়েকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করতে আসেন মা সীমা খাতুন। এসময় জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, মেয়ের চিকিৎসার জন্য হন্যে হয়ে যখন এ দরজা ও দরজায় কড়া নাড়ছিলাম, তখনই জেলা প্রশাসক আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার বন্ধুকে বলে আমার মেয়ের বিনামূল্যে অপারেশন করিয়েছেন। তিনি শুধু আর্থিক সহায়তাই করেননি, হতাশাগ্রস্ত পরিবারকে মানবতা দেখিয়ে রেখেছেন দৃষ্টান্ত। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ওই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। আর আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. ফয়েজুল ইসলাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি ওই রোগের খুব ভালো চিকিৎসা ও অপারেশন করে থাকেন। মানুষ হিসেবেও খুব ভালো। জিন্নাতারার বিষয়টি তাকে জানালে তিনি বিনামূল্যে অপারেশন করে দেন। বিপদে অসহায় দিনমজুর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পেরে খুব ভালো লেগেছে। বিপদে সকলকেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।