বঞ্চনার বৃত্ত থেকে মুক্তি নেই প্রশাসনের

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩২ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। গতকাল সোমবার পদোন্নতি পাওয়া ১৩০ জনের তালিকা প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বাকি দুই কর্মকর্তা প্রেষণে থাকায় তাদের প্রজ্ঞাপন পরে জারি করা হবে। এসব কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে এবার কমপক্ষে দুশতাধিক কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেওয়াজ অনুযায়ী পদোন্নতি প্রাপ্তদের ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে। এ পদোন্নতির পর প্রশাসনের অনুমোদিত ১২১টি অতিরিক্ত সচিবের পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৬৪ জনে। ফলে পদ না থাকায় পদোন্নতি পাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তাকে আগের পদেই (ইন সিটু) কাজ করতে হবে অথবা ওএসডি থাকতে হবে।

আরও জানা গেছে, অতিরিক্ত সচিবের মতো নির্ধারিত পদের তুলনায় যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদেও অতিরিক্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এ মুহূর্তে যুগ্ম সচিবের ৪১১টি পদের বিপরীতে ৬৪৯ জন এবং উপসচিবের এক হাজার ৬টি পদের বিপরীতে এক হাজার ৫৫২ জন কর্মরত। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের একজন, ১৯৮৪ ব্যাচের ১৩ জন, ১৯৮৫ ব্যাচের ৩২ জন, ১৯৮৬ ব্যাচের ২৫ জন এবং নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে নবম ব্যাচের ৪২ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থেকে ১৭ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে এবার কমবেশি ৮০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে এর আগে একাধিকবার বঞ্চিত হয়েছিলেন। অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩২ জনকে পদোন্নতি দিতে কমবেশি ২২৪ কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ও বিশেষ ব্যাচের ১৩ জন, ১৯৮৪ ব্যাচের ৪৭ জন, ১৯৮৫ ব্যাচের ১৩২ জন ও ১৯৮৬ ব্যাচের ৩২ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা বিচারাধীন অথবা চাকরির গোপন প্রতিবেদনে বিরূপ মন্তব্য থাকায় পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩০ জনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বাকিদের প্রজ্ঞাপন পরে জারি করা হবে।’ বিভিন্ন ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তা প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, ‘এসএসবির সুপারিশ অনুযায়ী পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। যারা পদোন্নতি পাননি তাদের কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে।’

জানা গেছে, বঞ্চিতদের অনেকেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মন্ত্রীদের একান্ত সচিব (পিএস), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। এর আগে একইভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতিতে সব স্তরে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছিলেন। ওই বঞ্চিতরাও আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, ‘বঞ্চনার বৃত্ত থেকে মুক্তি নেই প্রশাসনের।’ কারণ সরকার পরিবর্তন হলেই আগের সরকারের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালনকারীরা বঞ্চিত হবেন- এ যেন জনপ্রশাসনের ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এপিডি বা অ্যাপয়ন্টমেন্ট, পোস্টিং অ্যান্ড ডেপুটেশন) শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, নতুন করে নবম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর আগে বাদ পড়া ব্যাচের কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। যারা পদোন্নতি পাননি তাদের কেউ বলতে পারেন বঞ্চিত হয়েছেন, কিন্তু এখানে বঞ্চিতের কোনো বিষয় নেই। যারা পদোন্নতির শর্ত অর্জন করেছেন তারাই পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকে বলবেন যোগ্য ছিলাম পদোন্নতি পাইনি। কিন্তু দেখা যাবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা আছে, এসিআর-এ নম্বর কম, অনেকের প্রতিবেদনও খারাপ।’ পদোন্নতি পাওয়া বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে আগের পদেই পদায়ন করা হবে জানিয়ে ইউসুফ হারুন বলেন, সবাইকে পদায়ন করা যাবে না। যারা শিগগির পিআরএলে যাবেন তাদেরও পদায়ন করা হবে না।
পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেয়ার সমালোচনা করে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘পদ ছাড়া পদোন্নতি দেয়া উচিত নয়। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ অনিয়ম হয়ে আসছে। পদোন্নতি পাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আগের পদেই কাজ করতে হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ পড়ছে, যা মোটেও কাম্য নয়।’