বাজার সয়লাব ভেজাল মিমক্স ও ইনডোমেথাসিন ক্যাপসুলে

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল মিমক্স ও ইনডোমেথাসিন ক্যাপসুল। এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের উৎপাদিত এই দুটি ওষুধে ভেজাল শনাক্ত হওয়ার পরও দৃশ্যমান আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে একাধিকবার সতর্ক বার্তা প্রদান করা হয় এলবিয়নকে। এমনকি বর্তমান ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক যে কোনো ধরনের ভেজাল রুখতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। মহাপরিচালকের আন্তরিকতা, পেশাদারিত্ব এবং সততার কারণে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আগেভাগেই সতর্ক হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এ সংক্রান্ত তথ্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, হাতে গোনা দু’ একজন কর্মকর্তার সঙ্গে ভেজালকারীদের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মদদে এ ধরনের অপকর্মের সাহস পাচ্ছে এলবিয়ন। এদের মধ্যে দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছেন এমন এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন থাকায় নাম প্রকাশ করা হলো না। মধ্যমসারীর ওই কর্মকর্তা মূলত এলবিয়নকে শেল্টার দিয়ে থাকেন। তার বাড়ি ঢাকার আশপাশের একটি জেলায়। একইভাবে সহকারী পরিচালক পর্যায়ের আরেক কর্মকর্তা আছেন তালিকায়। এই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে এলবিয়নের মালিকপক্ষের দহরম-মহরম সম্পর্কের তথ্য পাওয়া গেছে।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের এলবিয়ন লাবরেটরিজ লিমিটেডের উৎপাদিত ইনডোমেথাসিন ক্যাপসুলে ইনডোমেথাসিন শনাক্ত হলেও দাবির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি। ক্যাপসুলে ইনডোমেথাসিন ২৫ মিলিগ্রাম বলা হলেও পরীক্ষায় পাওয়া যায় ২২.৫৯ মিলিগ্রাম। এই নমুনায় পাউডারের গড় ওজন মিলেছে ১৩০.৫৪ মিলিগ্রাম। একই ব্যথানাশক ক্যাপসুলের আরেকটি নমুনা পরীক্ষায় পাওয়া গেছে ২৪.১১ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল। আর ক্যাপসুলের পাউডারের গড় ওজন ১২৭.৮১৫ মিলিগ্রাম। ইনডোমেথাসিনের দুটি পরীক্ষায় দুই রকম তথ্য পাওয়া যায়। নমুনায় উল্লেখ করা দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না থাকায় মানবহির্ভূত বলে সরকারি বিশ্লেষক প্রতিবেদন দেন। ব্যথানাশক ইনডোমেথাসিন ক্যাপসুলের নমুনা দুটি সংগ্রহ করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে নওগাঁ এবং নেত্রকোনা এলাকা থেকে।

এদিকে নমুনা সংগ্রহের পর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন হাতে পেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করে ইনডোমেথাসিন উৎপাদন এবং বাজারজাত বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। অধিদফতরের পক্ষে চলতি বছরের ১৮ মে ও ২০ আগস্ট দুই দফায় এই চিঠি দেয়া হয়েছিলো। জবাবে এলবিয়ন ৪ এপ্রিল একটি ব্যাখ্যা দেয় অধিদফতরকে। এরপরও ওষুধের মান ঠিক না থাকায় আবারও সতর্ক করা হয় এলবিয়নকে। তারপরও বহাল তবিয়তে অপকর্ম করছে এলবিয়ন। কয়েকদিন আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন এ প্রসঙ্গে জানান, বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহের পর এলবিয়নের ওষুধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিলো। এতে ইনডোমেথানি শনাক্ত হলেও ওজনে তারতম্য ধরা পড়ে। এই কর্মকর্তার মতে, ভেজালের বিরুদ্ধে অধিদফতর কঠোর। এ থেকে কারো রেহাই নেই।

অপরদিকে এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন দাবি করে আসছেন, তার প্রতিষ্ঠানের ওষুধে ভেজাল নেই। জানা গেছে, ভেজাল ওষুধ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি হলে এলবিয়ন কর্তৃপক্ষ চাপে পড়ে যায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায় থেকে আবারো নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠায়। সংগৃহীত নমুনায় বিভিন্ন ধরনের আটটি ওষুধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক পর্যন্ত ওষুধে ভেজাল পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে কয়েকটি কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়। এরপরও নিম্মমানের, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন অব্যাহত আছে। ওষুধ প্রশাসন এসব বিষয়ে কঠোর থাকলেও আড়ালে বাজারজাত করে যাচ্ছেন প্রতারক ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, ওষুধের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকা। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের আখড়াও হচ্ছে এই মিটফোর্ড এলাকা। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভেজাল ওষুধ ছড়ানো হয়। কিছু প্রতারক ব্যবসায়ী এসব অপকর্ম করেন। এখান থেকেও এলবিয়নের ওষুধ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এলবিয়নের নির্দিষ্ট কিছু এজেন্টও রয়েছে। আর এই কোম্পানির ওষুধের দাম এতই কম যে, প্রতারক ব্যবসায়ীরা অতি লাভের আশায় বাজারজাত করছে। প্রশ্ন উঠেছে, এলবিয়ন এত কম রেটে (দাম) কীভাবে ওষুধ বাজারে দিচ্ছে। তাদের উৎপাদিত ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার এটিও একটি বড় কারণ। এরআগে এলবিয়নের এমোক্সিসিলিন গ্রুপের মিমক্স ক্যাপসুলটির নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এমোক্সিসিলিন শনাক্তই হয়নি। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন মোতাবেক এ তথ্য জানা যায়। মিমক্স ৫০০ মিলিগ্রামের ক্যাপসুলটির নমুনা পরীক্ষার পর সরকারি বিশ্লেষক তার মতামতে উল্লেখ করেছেন, নমুনায় এমোক্সিসিলিন শনাক্তই হয়নি। এ কারণে এটি মান বহির্ভূত। নোয়াখালীর ওষুধ প্রশাসন কার্যালয় থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ১০টি ক্যাপসুল ব্লিস্টারে পরিবেশিত, যার ভেতরে পাউডারের গড় ওজন পাওয়া যায় ৩৯০.২ মিলিগ্রাম।