কে এই আলফাজ উদ্দিন জোয়ার্দ্দার

ইসলাম রকিব: চলতি মাসের শুরু থেকেই চুয়াডাঙ্গা ক্রীড়াঙ্গণের বাতাসে মৃদু হাওয়ায় মসৃণ গুনজনে ভেসে বেড়াচ্ছে আলফাজ উদ্দিন ফুটবল টুর্নামেন্টের কথা। বহুল প্রচারিত দৈনিক মাথাভাঙ্গাসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এ টুর্নামেন্ট নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পাশাপাশি শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টুর্নামেন্টের নাম খচিত ব্যানারও শোভা পাচ্ছে। টাউন ফুটবল মাঠের পাশে তোরণও নির্মাণ করা হয়েছে। যে টুর্নামেন্ট নিয়ে এতো প্রচার-প্রচারণা, যে টুর্নামেন্টের নামকরণ করা হয়েছে ‘আলফাজ উদ্দিন স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’ টুর্নামেন্টের আলফাজ উদ্দিন কে? এ প্রশ্নটি অনেকে জানলেও অনেক পাঠকই আলফাজ উদ্দিন সম্পর্কে আরও স্পষ্ট জানতে চান। সে সকল পাঠকদের উদ্দেশ্যেই আজকের লেখা। কে এই আলফাজ উদ্দিন উদ্দিন জোয়ার্দ্দার?
চুয়াডাঙ্গা পোস্টঅফিসপাড়ার মরহুম বানাত আলী জোয়ার্দ্দারের ৩ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট আলফাজ উদ্দিন জোয়ার্দ্দার। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৯১২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের ছোটসন্তান হওয়ায় আলফাজকে কোনো হুকুম করতেন না। সে তার খেয়াল খুশি মতো চলাফেরা করতেন। একদিন স্কুলে গেলে পরের ২-৪ দিন তাকে স্কুল সীমানায় খুঁজে পাওয়া যেতো না। তাকে খুঁজে পাওয়া যেতো খেলার মাঠে। অবাক ব্যাপার হলো নিজে খেলা খেলতেন না, কিন্তু খেলা দেখার জন্য তাকে মাঠে পাওয়া যেতো। এ অবস্থা দেখে অতি আদরে আলফাজ সপ্তম শ্রেণি পাস করার পর বাবা বানাত আলী জোয়ার্দ্দার কাপড়ের ব্যবসায় বসিয়ে দেন আলফাজ উদ্দিনকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসেও আলফাজের স্বস্তি ছিলো না। যথনই শুনতো ফুটবল খেলা আছে। আর কে ঠেকায় তাকে। সুযোগ বুঝে চাবি-ছোড়ান মায়ের কাছে রেখে চলে যেতো খেলার মাঠে। খেলা দেখা যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছিলো। এ অবস্থা দেখে বাবা ১৮ বছর বয়সেই আলফাজ উদ্দিনকে বিয়ে দিয়ে দেন আলমডাঙ্গার নাগদাহ গ্রামের রফিউদ্দীন জোয়ার্দ্দারের মেয়ে ওহিরন নেছা জোর্য়দ্দারের সাথে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। এ নেশা শুধু বিয়ের আগে নয়, বিয়ে-সাদি করে ছেলে-মেয়ে জন্মদানের পরও তার খেলা দেখার নেশায় কমতি ছিলো না। তাই নিজের ছেলেদের খেলা দেখতেও ছুটে গেছেন, নাটোর, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে।
তিনি খেলোয়াড় না হয়েও ফুটবল খেলার প্রতি তার অপরিসীম ভক্তি, আর ভালোবাসার কমতি ছিলো না। এ ভালোবাসার কারণেই তিনি তার কোনো ছেলেকে ফুটবল খেলায় বাধা দেননি। নিজের ৫ ছেলে ও ৫ মেয়েকে সাধ্যমত পড়ালেখা শেখানোর পাশাপাশি ৫ ছেলের সকলকেই ফুটবল খেলার সুযোগ করে দেন। বড় ছেলে আব্দুল কাদের জোয়ার্দ্দার। তিনি এইচএসসি পাস করার পাশাপাশি তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা দলের নিয়মিত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি খুলনার মুসলিম ক্লাব, আগাখান গোল্ডকাপসহ বিভিন্ন লিগ ও ঢাকা, রাজশাহীর টুর্নামেন্টে খেলেছেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কৃতিত্বের সাথে ফুটবল খেলেছেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। মেজছেলে এ নাসির জোয়ার্দ্দার এইচএসসি পাস করে তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি ও চুয়াডাঙ্গা বাসমিনিবাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও বড় ভাই আব্দুল কাদের জোয়ার্দ্দারের মতো তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। খুলনার নিউ মুসলিম ক্লাব, ব্যাংকার্স ক্লাব, সোনালি ক্লাব, ঢাকার ওয়ারী, বিআরটিসিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ফুটবল খেলেছেন দাপটের সাথে। সেজছেলে মোতাহের আলী জোয়ার্দ্দার কালু। বিএসসি পাস করে কালুও তার বড় ভাইদের মতো ফুটবল খেলতেন। চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা ও পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গা জেলা দলের হয়েও ফুটবল খেলেছেন তিনি। ৪র্থ ছেলে মামুন জোয়ার্দ্দারের নাম তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা বাংলাদেশের ফুটবলপ্রিয় মানুষ জানে মামুন জোয়ার্দ্দার কে এবং তিনি কি ধরনের ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন।
বড় ভাই আব্দুল কাদের জোয়ার্দ্দার, এ নাসির জোয়ার্দ্দাররা চুয়াডাঙ্গা ফুটবলের নাম করা ফুটবলার হওয়ার সুবাদে মামুন জোয়ার্দ্দার (ইনবর্ন) জন্মগতভাবেই ফুটবল খেলার প্রতি আসক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে এক পড়ন্ত বিকেলে মায়ের গোছানো ৫ টাকায় কিনে দেয়া বল নিয়ে বড় ভাইদের হাত ধরে হাটি-হাটি পা পা করে চুয়াডাঙ্গা টাউন ক্লাব (টাউন ফুটবল) মাঠে পর্দাপণ করেন মামুন। মায়ের হাতের সেই ৫ টাকার ফুটবল নিয়ে যে শিশু খেলা শুরু করেছিলো, কে জান তো সেই ছেলেটিই একদিন বাংলাদেশ ফুটবল দলে ১১ বছর ধরে রাজসিক রাজত্ব করবে। চুয়াডাঙ্গার নাম তুলে ধরবে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পথে-প্রান্তর ও বিদেশের মাটিতে। মাত্র ১০ বছর বয়সে মামুন জোয়ার্দ্দার ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সর্ব প্রথম কোনো প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলায় (প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা) অংশগ্রহণ করেন। সেই প্রতিযোগিতায় চমক সৃষ্টি করে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন। সেই যে ফুটবলে চমক শুরু হলো আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক সাফল্য। পেলেন শতাধিক ট্রফি ও চ্যাম্পিয়নশিপ লাভ করে পাড়ি জমান ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। সেখানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের নির্বাচক ম-লীর দৃষ্টি কেড়ে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ঢুকে পড়েন। শুুধু তাই-ই- নয় রীতিমত জাতীয় দলে নিরবছিন্নভাবে ১১ বছর ধরে নিজের জায়গাটা টিকিয়ে রেখেছিলেন বীরত্বের সাথে। জাতীয় দলে কখনো লেপ্ট উইংগার ও কখনো রাইট উইংগার হিসেবে খেলে প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ার আতঙ্ক সৃষ্টিকারী মামুন জোয়ার্দ্দার বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন সিঙ্গাপুর, চায়না, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, কাতার, দুবাই, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, বার্মা, ভুটান, কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ১৯৯২ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত চার্স্মকাপ ফুটবলে ও সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত চার জাতি ফুটবলে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। এছাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফাইয়িং ম্যাচে জাপান ও কোরিয়ার বিরুদ্ধে দারুণ চমক সৃষ্টি করেছিলেন মামুন জোয়ার্দ্দার। এরপর সার্ক ও সাব ফুটবলে হ্যাটট্রিকসহ সর্বোচ্চ গোল দাতার পুরস্কার অর্জন করেন। দুপায়ে সমান গতিতে ফুটবল খেলতে সক্ষম চুয়াডাঙ্গা ফুটবলের কিংবদন্তি মামুন জোয়ার্দ্দার। ২০০১ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্র্নামেন্ট খেলার মধ্যদিয়ে ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা এ ফুটবল তারকা মামুন জোয়ার্দ্দার। পাশ বাংলাদেশ, আমেরিকা ও কানাডার যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ফোবানা সম্মেলনের স্পোর্টস সেক্রেটারি মামুন জোয়ার্দ্দার বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। মামুন জোয়ার্দ্দার ছিলেন এইচএসসি পাস। ছোটছেলে হাফিজুর রহমান ওরফে ছোট লিটনের ফুটবল শৈলীর কথাও চুয়াডাঙ্গাবাসী জানে। লিটন চুয়াডাঙ্গা জেলা টিমের নিয়মিত খেলোয়াড়রা হিসেবে খেলার পাশাপাশি শেরে বাংলা কাপসহ অসংখ্য ফুটবল লিগ ও টুর্নামেন্টে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি চুয়াডাঙ্গাতেই অবস্থান করছেন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। হাফিজুর রহমান লিটন এসএসসি পাস। এই ৫ কৃতি ফুটবলারের গর্বিত পিতা আলফাজ উদ্দীন জোয়ার্দ্দার । তিনি নিজে ভালো ফুটবল খেলোয়াড় না হলেও নিজের ছেলেদের লেখাপড়া সেখানোর পাশাপাশি সকলকে ফুটবল খেলায়াড় হিসেবেও তৈরি করেছেন। তাই ৫ ফুটবলার ছেলেদের যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হচ্ছে আলফাজ উদ্দিন ফুটবল টুর্নামেন্ট। এ টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে এ বছর ১৮টি দল দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় চুয়াডাঙ্গা টাউন ফুটবল মাঠে এ টুর্নামেন্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এ টুর্নামেন্টের বিশেষত্ব হলো। এ টুর্নামেন্টে চুয়াডাঙ্গার বাইরের কোনো খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এই ৫ কৃতি ফুটবলারের পিতা আলফাজ উদ্দিন জোয়ার্দ্দার ২০০৬ সালে ১৪ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন ৯৪ বছর বয়সে।