ঝিনাইদহে মহামারী আকারে শিক্ষাবাণিজ্য নীতিমালা লঙ্ঘন করে স্কুলগুলোতে এখন রমরমা কোচিং বাণিজ্য

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহ জেলার ৬টি উপজেলাতেই কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডার গার্টেন অ্যান্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুলসহ বেশিরভাগ স্কুলেই শিক্ষাবাণিজ্য মহামারী আকার ধারণ করেছে। নীতিমালা লঙ্ঘন করে স্কুলগুলো সব কোচিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন স্কুলে চলছে এখন রমরমা কোচিং বাণিজ্য। শিক্ষকরা কোমলমতি শিশুসহ সব শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের জিম্মি করে কোচিং করতে বাধ্য করে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। বাড়তি বই, কোচিং ও শিক্ষকের ধকল সামলাতে গিয়ে মানসিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সব স্কুল আজ কোচিং বাণিজ্যের রূপ নিয়েছে। বাড়তি টাকার লোভে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন একে জমজমাট ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। এটি শিক্ষকদের লোভে পরিণত হয়েছে। তাই ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিংয়ে পড়াচ্ছেন। কোচিং বন্ধে ঝিনাইদহের প্রশাসনের কোনো সদিচ্ছা রয়েছে বলেও মনে হয় না। এখনই এর বিরুদ্ধে সবারই অবস্থান নেয়া এবং কোচিং নিষিদ্ধ করা জরুরি বলে জেলার সচেতন অভিভাবক মহল মনে করছেন। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই কমলমতি শিশুদের আগ্রহে নয়, বরং তাদের ওপর কোচিং জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিংয়ের বদলে এর নাম দেয়া হয়েছে বিশেষ ক্লাস। এর জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি আদায় করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। ঝিনাইদহ সরকারি বালক বিদ্যালয়ের এক ছাত্রের অভিভাবক আমিনুল ইসলাম বিল্লু বিশ্বাস অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষকরা কোচিং করতে বাধ্য করছেন। শিক্ষার্থীদের দিনের ২৪ ঘণ্টার ১৮ ঘণ্টা কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, নোট বই পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এতে পরীক্ষায় পাস মিললেও জীবনের পরীক্ষায় ফল ভালো হবে না। কোমলমতি শিশুদের বাঁচাতে হলে এখন সবার আগে দরকার শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা ও বাহ্যিক জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভালো ফল অর্জনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নামে বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। অনেকে কাঙ্খিত ফল না পেলে সন্তানকে বকাঝকা করেন। এতে শিশুরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীদের সকল সৃজনশীলতা ও উৎসাহ হারিয়ে শিশুদের শৈশব দারুণভাবে নষ্ট করছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষের জন্য তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা জাগ্রত হচ্ছে না। ঝিনাইদহ কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ইউনুছ আলী ও হেলালী ফেরদৌসি বলেন, গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের বাড়তি চাপ নিতে গিয়ে শিশুরা মনস্তাত্ত্বিক সংকটে পড়ে। চাপে থাকা বাচ্চারা পাঠাভ্যাস হারিয়ে ফেলে। ভালো ফলের চাপে শিশুরা জ্ঞানতৃষ্ণা হারাচ্ছে। বাড়তি বই, বাড়তি কোচিং ও বাড়তি শিক্ষকের ধকল সামলাতে গিয়ে শিশুরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শিশুদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, রসবোধ ও নান্দনিকতার আত্মতৃপ্তি ইত্যাদি বিষয় হারিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে এক সময় শিশুদের মাঝে ব্যর্থতাবোধ ও মানসিক বৈকল্য ইত্যাদি সমস্যা গ্রাস করছে। এতে জাতির স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অভিভাবক আসমা সুলতানা, গোলাম রসুল বিশ্বাস ও শামীম আহম্মেদ মোল্লা বলেন, শুধুই পড়া আর পড়া! নেই কোনো বিনোদন-খেলাধুলা, আনন্দ-ফুর্তি। টিভি দেখারও সময় মেলে না। বাসায় একের পর এক শিক্ষক আসছেন, পড়াচ্ছেন। সঙ্গে স্কুলের ক্লাস ও কোচিং। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে হোমওয়ার্ক শেষ করা আবার বাধ্যতামূলক। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘুমের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময়ই পড়ালেখা। ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া দু’বোন মায়শা ও মার্জিয়ার অভিভাবক (পিতা) বলেন, দুটি মেয়েকে গালর্স স্কুলের শিক্ষকের নিকট কোচিং করাতে মাসে ১৮০০ (আঠারো শত) টাকা দিতে হয়। তারপর স্কুলের মাসিক বেতনসহ স্কুলে ও কোচিংয়ে যাওয়া-আশার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কি কোচিংয়ে না পড়ালে ভালো রেজাল্ট সম্ভব নয়, শিক্ষকরা ক্লাসে ভালো পড়ালে কোচিংয়ের প্রয়োজন হতো না। পড়ালেখার বাড়তি চাপে দিশেহারা এমন কয়েকজন শিশু প্রীতি, জান, প্রপা, ইভা ও ফাহিম জানায় তাদের সারাদিনই কাটে পড়াশোনার চাপে। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে তাদের পড়তে বসতে হয়। ক্লাস শেষে স্কুলেই ফের শুরু হয় কোচিং। বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে শেষ করার পরপরই গৃহশিক্ষক আসেন পড়াতে, অনেকের আবার বাহিরে কোচিং করতে যেতে হয়। বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৫২ দিন শুক্রবার থাকে। ৮৫ দিন থাকে সরকারি ছুটি। শুক্রবার ও ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই তাদের এ রুটিন মাফিক চলতে হয়। শিক্ষার্থীদের কথা অনুসারে হিসাব কষে দেখা যায়, ১০-১১ বছরের শিশুদেরকে দৈনিক গড়ে ১৩-১৪ ঘণ্টা পড়াশোনার চাপে থাকতে হয়। ঝিনাইদহ (সিটি) কলেজ এর প্রভাষক কামাল হোসেন বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কোন শ্রেণিতে পড়ার চাপ কতটুকু কোন বয়সে একটি শিশুর মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা কতটুকু, কোন শ্রেণিতে কয়টি বই পড়তে হবে সে বিষয় বিশ্লেষণ করে এনটিবি থেকে কী পড়ানো হবে তার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা আছে। এর বেশি একটি বইও কোনো বিদ্যালয় পড়াতে পারে না। পড়ালে তা আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করেই ঝিনাইদহের বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ইচ্ছামতো পাঠ্যপুস্তক পাঠদান করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০১৬ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ঝিনাইদহের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেতৃত্বে শহরের ১০টি কোচিংয়ে অভিযান পরিচালনা করে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। কিছুদিন কোচিং বন্ধ রাখার পর তা আবার স্থান পরিবর্তন করে একেকদিন একেক স্থানে কোচিং শুরু করেন। শহর জুড়ে শতাধিক কোচিং সেন্টারে কোচিং বাণিজ্য চলছে। কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেউ পড়াবে কেউ পড়াবেনা তা হবে না। একযোগে সব শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করলেই কেবল তা কার্যকর সম্ভব এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রাখলেই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হওয়া সম্ভব। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঝিনাইদহের অধিকাংশ প্রি-ক্যাডেট ও সরকারি-বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা নিজেরাই একেকটি কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন। কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িতরা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। ঝিনাইদহের অর্ধশত প্রি-ক্যাডেট স্কুলগুলো সকল নীতিমালা লঙ্ঘন করে বাধ্যতামূলকভাবে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কিন্ডার গার্টেন অ্যান্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুল অ্যাসোসিয়েশন, ঝিনাইদহ এর আহ্বায়ক ও অনির্বাণ প্রি-ক্যাডেট স্কুলের পরিচালক বিনয় কৃ বিশ্বাস বলেন, যে সব কিন্ডার গার্টেন স্কুলের রেজিস্টেশন আছে, সে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সকল নীতিমালা মেনেই স্কুল পরিচালনা বা পাঠদান করে থাকে। নিবন্ধন বিহীন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছা মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যে সব স্কুল সরকারের নীতিমালা লঙ্ঘন করে ক্লাসে পাঠদান ব্যতিরেকে শুধুমাত্র অর্থ আয়ের জন্য কোচিং বাণিজ্য করছে, সে সকল স্কুলগুলো তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অধিদফতর ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক, আইন লঙ্ঘনকারী স্কুলগুলো ছিলগালা ও বন্ধ ঘোষণা করে কমলমতি শিশুদের সুষ্ঠু শিক্ষারমান ফিরিয়ে আনা সম্ভব পর বলে তিনি মনে করেন। ঝিনাইদহের শিক্ষাবান্ধব ও সততার প্রতিক হিসেবে পরিচিত জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঝিনাইদহের সচেতন মহলের দাবি, জেলা প্রশাসকসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বাঁচাতে দ্রুত ঝিনাইদহের কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করা অতি জরুরী।