রোহিঙ্গা ফেরাতে এ সপ্তাহেই ঢাকা-নেপিদো চুক্তি

স্টাফ রিপোর্টার: পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য এ সপ্তাহেই নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দফতরের মন্ত্রী খিও তিন্ত সোয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। বৈঠকের পরও চুক্তিটি সইয়ের সম্ভাবনা আছে। আবার দু-এক দিন দেরিও হতে পারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর দ্বিপক্ষীয় সফরের প্রথমদিন। কাল বৃহস্পতিবার মাহমুদ আলী নেপিদোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। নেপিদো থেকে একাধিক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে চলতি সপ্তাহেই একটি স্মারক সই হবে। তার ভাষায় এরপরই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে এশিয়া ও ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসেম সম্মেলনের শেষ দিনে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সু চি এ ঘোষণা দেন। এদিকে আসেম সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে মিয়ানমার গেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দু-দিনের দ্বিপক্ষীয় সফর শুরু হচ্ছে আজ বুধবার। অপরদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, রাখাইন সংকট নিরসনে চীনের দেয়া তিন দফা প্রস্তাব বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েই মেনে নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে চুক্তিটি সই হবে তাকে বলা হচ্ছে, রাখাইন রাজ্য থেকে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো সংক্রান্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট। এ চুক্তি চূড়ান্ত করার ব্যাপারে দু’দেশের কর্মকর্তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করছেন। মিয়ানমার প্রথমে দুই দেশের মধ্যে ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কথা বলেছিলো। বাংলাদেশ বলেছে, সেই সময় এবং এখনকার চ্যালেঞ্জ এক নয়। ওই সময় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়নি। বাংলাদেশ একটি নতুন চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের কাছে আগেই দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নতুন চুক্তির কিছু অংশ সংশোধন করে নতুন চুক্তির ব্যাপারে মিয়ানমার রাজি হয়েছে। এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর অন্তর্ভুক্ত থাকছে। তবে মিয়ানমার বলছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর আসা রোহিঙ্গাদেরই তারা ফিরিয়ে নিতে চায়। বাংলাদেশ বলছে, এ দেশে পালিয়ে আসা সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, চুক্তিটি আজ-কালের মধ্যে যে কোনো দিন সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মিয়ানমারের নেত্রী সু চিও একই ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশের সঙ্গে একটি এমওইউ সই করার চেষ্টা করছি, যার অধীনে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হবে।’ তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, ‘রাতারাতি কোনো কিছুই করা সম্ভব হবে না। আমরা ধীরে হলেও অগ্রগতির আশা রাখি।’ গত আগস্টে রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী বিরোধী অভিযান শুরুর জেরে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পুরনো রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ। অভিযানের সময় রাখাইনে মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস হত্যা, ধর্ষণসহ নিপীড়ন চালায় বলে অভিযোগ করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে সু চি বলেন, সেখানে এমন কিছু হয়েছে কি হয়নি তা আমরা বলতে পারবো না। সরকারের দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমাদেরকে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে যেন এমনটি না ঘটে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে সু চি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বুধ ও বৃহস্পতিবার আলোচনা হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে গত মাস থেকেই দু’দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা শুরু করেছেন। তবে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উল্লেখ করেননি শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি।

তিনি আরও বলেন, রাখাইনে দ্রুত শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো মিয়ানমারকে সহায়তা করতে আগ্রহী। প্রসঙ্গত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণভাবে ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইইউ অভিন্ন নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি ফেডেরিকা মোঘেরিনি বলেছেন, শরণার্থীদের উৎসে ফেরত যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। ইইউ রাখাইনে মানবাধিকার ও মানবিক পরিস্থিতিকে গুরুতর বলে অভিহিত করেছেন। ইইউ রাখাইনে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এশিয়া ও ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রাখাইনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
সোমবার সকালে বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে মিলিত হন। মিয়ানমার, বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইস্তোনিয়া, জার্মানি, মাল্টা, রাশিয়া, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং ইইউ উচ্চ প্রতিনিধি ব্রিফিং সেশনে যোগ দেন। এদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছেন। সফরে তিনি তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এই তিন দফার মধ্যে রাখাইন রাজ্যে অস্ত্রবিরতি ও সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা, এই সমঝোতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন কামনা এবং রাখাইনের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তার প্রস্তাব দেন। চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, চীনের এ প্রস্তাব বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েই মেনে নিয়েছে।