শিশু ইরা’র ভবিষ্যত এখন শুধুই অন্ধকার!

কাঞ্চন কুমার: তিন বছরের ফুটফুটে শিশু ইরা এখনো জানে না তার জন্মদাত্রী মা আর বেঁচে নেই! মায়ের মতো যাকেই দেখছে তাকেই মা ভেবে জড়িয়ে ধরছে। ফুলের মতো নিষ্পাপ এই শিশুকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে দরিদ্র-অসহায় নানা-নানি, খালা এবং মামা। খালা জেসমিনকে মা মনে করে তাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিতে চাচ্ছে না। ইরা বর্তমানে নানা-নানির কাছে রয়েছে। পরিবারের লোকজনের অভিযোগ যৌতুকের দাবিতে স্বামী-শাশুড়িসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন চালিয়ে তাদের আদরের কন্যা গৃহবধূ শিরিনা খাতুনকে হত্যা করেছে।

পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, প্রায় চার বছর আগে মিরপুর উপজেলার চারুলিয়া গ্রামের ট্রাকচালক রবিউল ইসলামের সাথে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের সাহাবুদ্দিনের মেয়ে শিরিনা খাতুনের (২০) বিয়ে হয়। রবিউল লেখাপড়া তেমন একটা না জানলেও শিরিনা কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে। বিয়ের কয়েকমাস যেতে না যেতেই স্বামী রবিউল, শাশুড়ি, ননদসহ পরিবারের লোকজন যৌতুকের জন্য গৃহবধূ শিরিনার ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। শিরিনার রং মিস্ত্রি দরিদ্র পিতা মেয়ের সুখের কথা ভেবে কয়েক দফায় জামাই রবিউলের হাতে ২ লাখ টাকা যৌতুক তুলে দেয়। কিন্তু এরপরও আরো টাকার দাবিতে শিরিনার ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। এর মধ্যে রবিউল-শিরিনা দম্পতির কোলজুড়ে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। নির্যাতন সহ্যতে করতে না পেরে গৃহবধূ শিরিনা খাতুন ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিলে কুষ্টিয়া মডেল থানায় শাশুড়ি আছমা খাতুন, ননদ বিউটি ও ননদের স্বামী সাইদুলের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। কিন্তু জিডি’র পরও শিরিনার ওপর নির্যাতনের খড়গ থামেনি। বরং বেড়ে যায়। শিরিনার মৃত্যুর চার মাস আগে থেকে রবিউল মিরপুর থেকে কুষ্টিয়া শহরের পশ্চিম মজমপুর এলাকার কাঠব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ি ভাড়া নেয়। গত ৬ জুলাই সন্ধ্যায় ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় গৃহবধূ শিরিনার মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করে। প্রতিবেশীদের অভিযোগ দু একদিন পর পরই ওই বাড়ি থেকে চিৎকার, কান্নাকাটি শোনা যেতো। ঘটনার দিন সকালেও চিৎকার, কান্নার আওয়াজ প্রতিবেশীরা শুনেছেন। পুলিশ শিরিনার দেহ মাটিতে নামানোর পর পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরা শিরিনার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান।

শিরিনার মা বেলী খাতুন অভিযোগ করেন, তার মেয়েকে তার জামাই, শাশুড়ি, ননদসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে।

এ ঘটনায় শিরিনার বড়বোন জেসমিন খাতুন বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় শিরিনার স্বামী রবিউল ইসলাম ও শাশুড়ি আসমা খাতুনের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় ঘটনার পরের দিন গত ৭ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী) ০৩ এর ১১ (ক) ৩০ অনুযায়ী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পুলিশ এ ঘটনায় শিরিনার স্বামী রবিউল ইসলাম ও শাশুড়ি আসমা খাতুনকে গ্রেফতার করে। রবিউল এখনো কারাগারে থাকলেও কুষ্টিয়া এলজিইডিতে পিওন হিসেবে কর্মরত শিরিনার শাশুড়ি আসমা খাতুন অসুস্থ সেজে আদালত থেকে জামিনে আছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে আদালত থেকে বের হয়ে শিরিনার স্বামী আসমা খাতুন মামলা তুলে নেয়ার জন্য শিরিনার পরিবারকে অব্যাহতভাবে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ইতোমধ্যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পুলিশের হাতে এসেছে। ময়নাতদন্তে এটি আত্মহত্যা বলে রিপোর্ট এসেছে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে তারা তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন শিরিনাকে তার স্বামী-শাশুড়িসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের প্ররোচণা দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। চলতি মাসেই এ ব্যাপারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে এ পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।