যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর

আলমডাঙ্গা দুর্লভপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার মেম্বার হত্যা মামলা

যশোর প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা দুর্লভপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন মেম্বার হত্যা মামলায় ২ আসামি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। গতরাতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত পৌনে ১২টায় তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডিআইজি (প্রিজন) টিপু সুলতান, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সুপার কামাল হোসেন, জেলার আবু তালেব, যশোর জেলা ও পুলিশ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এর আগে সকালে আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর পরিবারের ৩৫ জন সদস্য কারাগারে তাদের সাথে দেখা করে। ফাঁসি কার্যকর করার পর রাতেই তাদের দু’জনের লাশ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়।
আদালত ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত রবকুল মণ্ডলের মেজ ছেলে মনোয়ার হোসেন ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দু’বার ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। কৃতিখেলোয়াড় হিসেবেও ছিলেন পরিচিত। ভারতের পশ্চিম-বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে হা-ডু-ডু খেলে বেড়িয়েছেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন গ্রামের বাদল সর্দ্দারের বাড়িতে তাকে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কতিপয় চরমপন্থিরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। ওইদিনই নিহতের ভাই মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ ১ যুগ পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়। রায়ে দুর্লভপুরের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মোকিম ও একই গ্রামের মৃত আকছেদ আলীর ছেলে গোলাম রসুল ঝড়ুসহ ৩ জনকে দেয়া হয় মৃত্যুণ্ডাদেশ এবং দুর্লভপুরের মৃত কুদরত আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম ও একই গ্রামের আবু বক্করের ছেলে হিয়াসহ দু’জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেয়। বাকি ১৬ জন আসামি বেকসুর খালাস পায়। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে আপিল করে ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত একজন ও যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশপ্রাপ্ত দু’জন আমিরুল ইসলাম ও হিয়ার দণ্ডাদেশ মওকুফ করা হয়। মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এদিকে, নিহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার মেম্বারের ছেলে কুমারী ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দু’আসামির ফাঁসির বিষয়টি কয়েকদিন পূর্বে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ও চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিলো। ফাঁসি কার্যকরের পর ঝড়ুর লাশ গ্রহণ করেন তার ছেলে তরিকুল ইসলাম। তিনি আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ বেতবাড়িয়া গ্রামে বসবাস করেন এবং মোকিমের লাশ গ্রহণ করেন তার ছেলে মখলেছ আলী। তিনি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামে বসবাস করেন। রাতেই তারা লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, আলমডাঙ্গা দুর্লভপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার মেম্বার হত্যার আসামি মোকিম ও ঝড়–র ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ প্রায় ২ যুগ পর গতকাল ১৬ নভেম্বর রাত পৌনে ১২টায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লাশ গ্রহণের জন্য স্বজনরা গতকালই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হন। জানাজা শেষে আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় মোকিম ও ঝড়ুর লাশ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হবে। দ-প্রাপ্ত আব্দুল মোকিমের লাশ গ্রহণের জন্য তার ছেলে মখলেছ, জামাই ও সংশিষ্ট ইউপি মেম্বার নুহু এবং গোলাম রসুল ঝড়ুর লাশ তার ছেলে তরিকুল ইসলাম, ঝড়ুর ছোট ভাইয়ের ছেলে আশিক, জামাই লিমন ও লিটন, সংশ্লিষ্ট ইউপি মেম্বার আব্দুল মজিদ ও বেল্টু মেম্বার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুঝে নেন।
স্বজনরা জানান, সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মোকিম ও ঝড়ুর সাথে স্বজনদের দেখা করার সুযোগ দেয় জেল কর্তৃপক্ষ। এর আগেও তাদের স্বজনরা গত মঙ্গলবার দেখা করে গেছেন বলে জানান। রাত ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দীন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কুমার রায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। এ সময় জেলগেটে অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়।
যশোরের জ্যেষ্ঠ জেলসুপার কামাল হোসেন সাংবাদিকদের জানান, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে একই সময়ে দুটি মঞ্চে দু’জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দণ্ডিতরা হলেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামের মৃত আকছেদ আলীর ছেলে গোলাম রসুল ঝড়ু (৭৫) ও একই এলাকার মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মোকিম (৬০)। এরা দু’জনই চরমপন্থি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি আরো জানান, কারাগারে ময়নাতদন্ত শেষে ঝড়ুর ছেলে তরিকুল ইসলাম এবং মোকিমের ছেলে মোকলেছ তাদের পিতার মরদেহ বুঝে নিয়েছেন। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশ দুটি কারাগার থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান তিনি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন যশোর জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান ও সিভিল সার্জন দিলীপ কুমার রায়। এর আগে কারাগার মসজিদের পেশইমাম তাদেরকে তওবা পড়ান।
লাশ পৌঁছুনোর পর জানাজা শেষে আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার ভোলারডাঙ্গা গ্রামের কবরস্থানে মোকিমের লাশ দাফনের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য আরোজ আলী। ঝড়–র পরিবার বসবাস করে আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রামে। ঝড়–র লাশ দাফন করা হবে বেলা ১১টার দিকে গ্রামের কবরস্থানে।
নিহত মনোয়ার হেসেনের স্বজনদের প্রতিক্রিয়া: নিহত মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার মেম্বারের ছেলে কুমারী ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি কয়েকদিন আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ও চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ তাকে জানায়। তবে দিনক্ষণ জানায়নি তারা। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দীর্ঘ ২৩ বছর পর পিতা হত্যার বিচার পাচ্ছি। অবশ্যই খুশি।
মনোয়ারের স্ত্রী চায়না খাতুন বলেন, ‘বছরের পর বছর চোখের জলে বুক ভাসিয়েছি। আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। তার দরবারে হাজার শুকরিয়া। খুনি দু’জনের ফাঁসি কার্যকর হলো। নিহতের ছোটভাই মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বলেন, একসাথে দু’ভাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। কত স্মৃতি আছে আমাদের। দু’যুগ পরে হলেও খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের সংবাদ শুনে ভালো লাগছে।