দর্শনার আকন্দবাড়িয়ায় কেরুজ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট অনিয়মের আখড়া

কিসের গবেষণা হয় জানে না চাষীরা: কাজ করেন দিন হাজিরার লেবাররা
নজরুল ইসলাম: এলাকার আখ চাষকে উন্নত করতে সরকারিভাবে গড়ে উঠেছে সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট। উন্নত জাতের আখ উদ্ভাবন এবং উন্নত চাষ পদ্ধতির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮১ সালে চুয়াডাঙ্গাতে গড়ে উঠে সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির তিন যুগ পেরিয়েছে। টানা এ ৩৬ বছরের অর্জন নিয়ে আখচাষী মহলে উঠেছে প্রশ্ন? কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করা হলেও কি নিয়ে গবেষণা এবং কিসের গবেষণা তা আদৌ জানে না চাষীকূল। আবার এ প্রতিষ্ঠানে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয় তারা কখন আসে, কখন যায় আসলেই কর্মকর্তারা আসেন কি না? তা দেখভাল করারও কেউ নেই। চিনিশিল্প বাঁচাতে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি না থাকলেও দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি দায়িত্বহীন হয় তাহলে কোনোভাবেই বাঁচানো যাবে না এ শিল্প। অথচ কর্তৃপক্ষ ঠিকমত প্রতিষ্ঠানে না আসায় গবেষণার কাজ করে দিন হাজিরার লেবাররা! প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দেখা দেয় গাত্রদাহ্য।
জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দর্শনা কেরুজ চিনিকল। দেশ বিভাগের আগে ও পরে কেরুজ চিনিকলের পাশাপাশি সেতাবগঞ্জ, নর্থ বেঙ্গল, রংপুর, জিল বাংলা, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মোবারকগঞ্জ, শ্যামপুর, পঞ্চগড়, ফরিদপুর, নাটোর, ও পাবনা সুগারমিল নামে আরও ১৪টি চিনিকল গড়ে উঠে। যে এলাকার মাটি আখ চাষের জন্য উপযুক্ত সে সমস্ত এলাকাতে গড়ে উঠে এ চিনিকলগুলো। ফলে চিনিকলকে কেন্দ্র করে এসব এলাকাজুড়ে হয় আখ চাষ। কারণ চিনিকলের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে আখ। আর আখের উন্নয়ন ঘটাতে ১৯৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে এ কেন্দ্রটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন তৎকালীন বাংলাদেশ চিনিকল সংস্থার নিকট হস্থান্তর করা হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার নির্বাহী আদেশবলে ইক্ষু গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কে বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) স্থাপন করেন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ ইক্ষুর উন্নত জাত ও উন্নত উৎপাদন কলা কৌশল উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত উন্নত জাত ও উন্নত উৎপাদন কলা-কৌশলসমূহ আখ চাষীদের মধ্যে বিস্তার ঘটানো। পরবর্তীতে ৬টি আঞ্চলিক উপকেন্দ্র গড়ে উঠে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের কেদারগঞ্জে ১৯৮১ সালে অস্থায়ী কার্যালয়ে কাজ শুরু করে এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের কেরুজ আকন্দবাড়িয়া বীজ উৎপাদন খামারে চিনিকলের জমিতে ২০০৮-০৯ সালে ২ একর জমির ওপর ৬ কক্ষ বিশিষ্ট একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ হয়। মূলত এখানে ইক্ষুচাষী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ, চাষীদের জমিতে নতুন প্রযুক্তিসমূহের প্রদর্শনী করা, বিভিন্ন ধরণের প্রকাশনার মাধ্যমে চাষাবাদের নতুন খবরের বিস্তার ঘটানো, চাষীদের জমিতে নতুন প্রযুক্তির উপযোগিতা যাচাই করা এবং এর ফিডব্যাক তথ্য সংগ্রহ করা। এ পর্যন্ত বিএসআরআই ৩৪টি ঈক্ষুজাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করেছে। এর সবগুলোই উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনি সমৃদ্ধ বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। আকন্দবাড়িয়ায় অবস্থিত ইক্ষু গবেষণা উপকেন্দ্রটি তাদের কাজের অংশ হিসাবে ২০১৬ সালে প্রদর্শনী প্লট করেছে ৫টি, সেগুলো হলো জীবননগরের উথলীতে ১টি, কালীগঞ্জের শ্রীরামপুরে ১টি, দর্শনার দক্ষিণচাঁদপুরে ১টি এবং দামুড়–হুদার বড় দুধপাতিলায় ১টি। একই বছর প্রত্যায়িত বীজ প্লট করেছে জীবননগরের দেহাটি গ্রামে ১টি, লোকনাথপুরে ১টি, কালীগঞ্জের চাঁদবা গ্রামে ১টি এবং বড় দুধপাতিলা গ্রামে ১টি। আর ২০১৭ সালে ইক্ষু বীজ বিতরণ করেছে কালীগঞ্জের আড়পাড়ায় মাত্র ১টি। একই বছর প্রদর্শনী প্লট করেছে মাত্র ২টি। দর্শনা দক্ষিণচাঁদপুর আর কালীগঞ্জের কাশিপুরে। প্রতিটি প্লটের জন্য একজন চাষীকে দিয়েছেন ২৫ মন বীজ, ৩০ কেজি টিএসপি, ৩০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি এমওপি আর ৩ কেজি রিজেন। এ অফিসে কর্মরত আছে একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওমর খইয়ুম, পরীক্ষাগার পরিচারক আবু আওয়াল হোসেন, সুজন মোল্লা, গোলাম রসূল, রেজাউল হক দিন হাজিরার লেবার এবং আমেনা খাতুন ক্লিনার। এদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওমর খইয়ুম (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাসে দু’একবার নিজের খেয়াল খুশি মত অফিসে আসেন আর যান। বেশির ভাগ সময় তিনি থাকেন ঈশ্বরদীতে। বরিশাল গৌরপুরের আবু আওয়াল হোসেন ২৫ বছর ধরে একই জায়গায় রয়েছেন বহাল তবিয়তে। স্থানীয়রা জানান, গবেষণার কাজ করে দিনহাজিরার লেবাররা। অনেকেরই অভিযোগ এখানে কিসের গবেষণা হয় ৩৬ বছর ধরে? আর বরাদ্দকৃত অর্থ কিভাবে খরচ হয়? আর কাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তা অনেকেরই অজানা। এত অর্থ খরচ করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ চাষীরা তেমন কোনো সুবিধা পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। খাতা কলম ঠিক রেখে কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিজের দৈনন্দিন কাজ সারেন। এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আখচাষী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারি বিশ্বাস বলেন, এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা বসে বসে মাসিক বেতন তোলা ছাড়া আর কিছু করে বলে আমার জানা নেই। বেগমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেন জোয়ার্দ্দার বলেন, প্রতিষ্ঠানটি আমার ইউনিয়নে হওয়ায় বছরে দু’একবার চাষীদের নিয়ে কিছু আলোচনা হয় এই যা। বেগমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, একসময় প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ছিলো। বর্তমানে নেই। এখানে সরকারি অর্থ অপচয় ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয় বলে আমার জানা নেই। কেরুজ চিনিকলের ইক্ষু মহাব্যবস্থাপক সহরোয়ার্দী বলেন, বছরে একবার আমাদেরকে ঈশ্বরদীতে নিয়ে প্রশিক্ষন দিয়ে থাকে তারা। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি কেরুজ চিনিকলের সাথে সংশ্লিষ্ট না। তবে এক সময় ছিলো। মূলত আখচাষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিলো এ প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওমর খইয়ুম মোবাইল ফোনে বলেন, আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। তাই ঠিকমত অফিসে যেতে পারি না। সপ্তাহে এক দুইদিন যাওয়া পড়ে। সার্বক্ষনিক প্রতিষ্ঠানে থাকা পরীক্ষাগার পরিচারক আবু আওয়াল হোসেনের নিকট এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিরক্তির সুরে বলেন, এখানে সরকারিভাবে তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। যেমন বরাদ্দ তেমন আয়োজন। আর এর চাইতে বেশিকিছু জানতে চাইলে ঈশ্বরদীতে যান। উল্লেখ্য, বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান ইক্ষুসহ তাল, খেজুর, গোলপাতা, সুগারবিট, স্টেভিয়া ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় ফসলের গবেষণা, প্রযুক্তি ও কলাকৌশল উদ্ভাবন করছে বলে জানা গেছে।