স্টাফ রিপোর্টার: ব্যবসায়ীদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক, মজুদদারদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান ও আমদানি শুল্ক সর্বনিম্নস্ত্মরে নামিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের পরও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় সরকার এবার সারাদেশে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেছে। এতে এ কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল পাওয়া সুবিধাভোগী ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে বন্যাকবলিত এলাকার হতদরিদ্র, অসচ্ছল বয়স্ক নারী প্রধান এবং উপার্জনাক্ষম দুস্থ ও প্রতিবন্ধী পরিবারগুলো রীতিমতো চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ২৮ সেপ্টেম্বর সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি স্থগিত করার পর সুবিধাভোগী হতদরিদ্র পরিবারগুলো দিশেহারার মতো প্রশাসনের বিভিন্ন দ্বারে ছোটাছুটি করছেন। যে কোনোভাবে এ কর্মসূচি চালু করার জন্য তারা নানাভাবে আকুতি জানাচ্ছেন। তাদের ভাষ্য, সাধারণ গৃহস্থের ঘরেও এখন ধান-চাল নেই। বাজারে মোটা চালের দর চড়া। ওএমএসের চালের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এ সময় ফেয়ার প্রাইসে (১০ টাকা কেজি) চাল দেয়া না হলে হতদরিদ্র অনেক পরিবারকে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হবে। আমন ধান না ওঠা পর্যন্ত্ম অর্থাৎ নভেম্বরের শেষভাগ পর্যন্ত্ম এ সংকট চলমান থাকবে। যা কাটিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে বাস্ত্মবিক অর্থেই কঠিন। গালভরা আশ্বাস দিয়ে সরকারের এভাবে পিছুটান দেয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি বলেও মন্ত্মব্য করেন অনেকে।
প্রসঙ্গত, প্রতি বছর মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে চালের দাম কিছুটা বেশি থাকায় এ সময়ে হতদরিদ্র পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত্ম নেয় সরকার। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের চিলমারীতে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরম্নদ্দেশ- এ স্লোগানে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে এই চাল দেয়া শুরু হয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিধবা ও প্রতিবন্ধী নারীদের প্রাধান্য দেয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সচ্ছল পরিবারকে এতে তালিকাভুক্ত করার বিস্ত্মর অভিযোগ ওঠে। যদিও সবকিছুর পরেও এ কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল এ দুমাস ফেয়ার প্রাইসে চাল বিতরণ করা হলেও আগাম বন্যায় হাওর অঞ্চলের বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতির পর চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির নীতিমালা লঙ্ঘন করে নানা টালবাহানায় সেপ্টেম্বর মাসে তা বন্ধ রাখা হয়। যদিও অক্টোবরে তা চালু করার বিষয়টি গুরম্নত্বের সাথে বিবেচনায় রাখে সরকার। তবে আমদানি শুল্ক হ্রাসসহ সরকারি নানা উদ্যোগের পর চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় সেপ্টেম্বরের শেষভাগে তড়িঘড়ি করে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. নুরুল ইসলাম শেখ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি স্থগিতের অনুমোদন নির্দেশক্রমে জ্ঞাপন করা হয়। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে পাঠানো এ চিঠিতে ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-খুলনা-সিলেট-বরিশাল ও রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রককে পৃষ্ঠাঙ্কন করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, পরিবারপ্রতি ৩০ কেজি করে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য মাসে দেড় লাখ টন চাল দিতে হয়। এ হিসেবে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এ তিন মাসে সাড়ে ৪ লাখ টন চাল প্রয়োজন। তবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি লঙ্ঘন করে যেহেতু সেপ্টেম্বর মাসে চাল বিতরণ করা হয়নি সেহেতু ৩ লাখ টন চাল হলে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে তা চালু রাখা সম্ভব। কিন্তু এ সামর্থ্য সরকারের নেই। বর্তমানে সরকারের গুদামে সর্বমোট চাল মজুদ রয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ১৩ লাখ টন। তাই তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু চলতি মাসেই নয়, নভেম্বরেও ফেয়ার প্রাইসে চাল বিতরণ বন্ধ থাকবে বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
এদিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নীতিমালায় কোনো ধরনের সংশোধনী না এনে তড়িঘড়ি করে তা স্থগিতের ঘোষণা কতটা যুক্তিযুক্ত সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউই এ ব্যাপারে কোনো মন্ত্মব্য করতে চাননি। যদিও নীতিমালার ১০ ধারার ১০.১ উপধারায় সরকার প্রয়োজনবোধে এ নীতিমালার যে কোনো শর্ত ও বিষয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করতে পারবে বলে সুনির্দিষ্টভাবে উলেস্নখ রয়েছে। তবে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, নীতিমালার উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি এ কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়টি শুধু অযৌক্তিকই নয়, উদ্ভটও বটে। তার ভাষ্য, দেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে তৈরিকৃত খাদ্যবান্ধব নীতিমালায় কোনো ধরনের সংশোধনী না এনে তা স্থগিত ঘোষণা সাপেক্ষে লঙ্ঘনের বিষয়টি রীতিমতো দৃষ্টিকটুও।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে প্রণিত ইউনিয়ন পর্যায়ে হতদরিদ্রের জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যশস্য বিতরণ নীতিমালা, ২০১৬ সংশোধন/পরিবর্তন করে কার্যক্রম আরও সুসংহত এবং সময়োপযোগী করার জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নীতিমালা, ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়। এদিকে অগ্নিমূল্যের চালের দরের এই দুঃসময়ে ঢাকঢোল পেটানো ‘ফেয়ার প্রাইসে’ চাল বিক্রির নির্ধারিত কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ রাখায় হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে হতাশার পাশাপাশি প্রচ- ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আগামী নির্বাচনে ভয়াবহ পড়বে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জোরালো আশঙ্কা করছেন। তাদের ভাষ্য, ১০ টাকা কেজি দরের চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তার দ্বিতীয় টার্মের মাঝামাঝিতে ৫০ লাখ পরিবারকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় আনলেও সর্বস্ত্মরের ভোটারদের মাঝে তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের বিপুলসংখ্যক ভোটারের মাঝে সরকার নিরঙ্কুশ আস্থা সৃষ্টির সর্বোচ্চ সুযোগ তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে আকস্মিক এ কর্মসূচি বন্ধ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের আস্থার প্রাচীরে বড় চির ধরবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেস্নষকরা। তাদের এ আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের অনেকেই তা নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনা বিভাগের একজন খাদ্য কর্মকর্তা জানান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকাভুক্ত বিপুলসংখ্যক হতদরিদ্র পরিবার গোটা সেপ্টেম্বর মাসে অসংখ্যবার তার কাছে ফেয়ার প্রাইসে চাল বিতরণ কবে শুরম্ন হবে তা জানতে চেয়েছে। এ সময় তিনি আজ-কাল করে ও নানা টালবাহানায় তাদের ঘুরিয়েছেন। তবে ২৮ সেপ্টেম্বর তা স্থগিত সংক্রান্ত্ম চিঠি হাতে হাওয়ার পর তিনি এ বিষয়টি তাদের সাফ জানিয়ে দেন। এতে কেউ কেউ হতাশা প্রকাশ করলেও অধিকাংশ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন বলে জানান ওই খাদ্য কর্মকর্তা।
এদিকে শুধু খুলনাই নয়- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা অনেকটা একই সুরে হতদরিদ্র পরিবারের হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশের কথা বর্ণনা করেন। এটি অসহায় দুস্থ মানুষকে নিয়ে সরকারের নোংরা রাজনীতির খেলা বলেও অনেকে মন্ত্মব্য করেন। তবে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে খাদ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ সংকটের জন্য সরকারের অদূরদর্শিতা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশি দায়ী। এছাড়াও দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চালের প্রকৃত মজুদ তথ্য সংগ্রহ করতে না পারাকেও দোষারোপ করেন তারা। ওই কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বন্যা-খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দুর্নীতির নানা ফাঁদ বিবেচনায় না রেখেই সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয় খাদ্য নিরাপত্তার যে ছক কষেছে তাতে বড় ধরনের ফাঁক থেকে গেছে। আর সরকারকে এখন তারই খেসারত দিতে হচ্ছে- যোগ করেন তারা। এদিকে বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চালের বিকল্প আটা-ময়দার মজুদও পর্যাপ্ত নয়। সরকারের ঘরে মাত্র ১ দশমিক ৩৬ লাখ টন গম রয়েছে। এছাড়া বন্দরে ভাসমান অবস্থায় ১ দশমিক ৬৫ টন খাদ্যশস্য আছে। তাই হতদরিদ্রের বিকল্প চাহিদা পূরণেরও সুযোগ কম। এ পরিস্থিতিতে দ্রম্নত বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে মোটা চালের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে না পারলে হতদরিদ্র পরিবারগুলো ভয়াবহ বিপাকে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।