দর্শনা কেরুজ চিনিকল এলাকায় হ্রাস পেয়েছে আখ চাষ
নজরুল ইসলাম: প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদনের জন্য রয়েছে নিজেস্ব কাঁচামাল। কাঁচামালের যোগান ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন। আর উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে লাভ লোকশান। আর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যারা কাঁচামাল সরবরাহ করে তারা হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। প্রতিষ্ঠানের কর্তাবাবু যদি অন্যের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে রক্তচক্ষু দেখায় তাহলে মাঠ পর্যায়ের কাঁচামাল উৎপাদনকারীরা হয় বিমুখ। ফলে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সভাসমাবেশ আর নীতিবাক্য আওড়িয়েও লাভ হয় না। এমনি দশায় পরিণত হয়েছে দর্শনার ঐতিহ্যবাহী কেরুজ চিনিকলটিতে। মূল্য এবং কতিপয় কর্তাবাবুদের আচরণের কারণে দর্শনা চিনিকলের আওতাধীনে আখচাষ হ্রাস পেয়েছে বলে সচেতন মহল মনে করছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের শিল্প স্থাপনাগুলোর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লি. একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। ১৯৩৮ সনে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১ হাজার টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় করণ করা হয় এবং তখন থেকে অদ্যবদি এটি কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লি. নামে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় ১১ হাজার ৫শ মে. টন। গত বছর বিএমআরই করণের কারণে এর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে জমির পরিমান খামার ৩৩৩৫ দশমিক ৫৬ একর, কারখানা ও কলোনী ১৬৬ দশমিক ১৮ একর, ইক্ষুক্রয় কেন্দ্র ৫ দশমিক ৩০ একর, মিল হতে খামারে যাওয়ার রাস্তা ও পাশ্ববর্তী জমির পরিমান ৪৮ দশমিক ৩৫ একর, পরীক্ষামূক বীজ উৎপাদন খামারে (আকন্দবাড়িয়া) ২৭৯ দশমিক ৭২ একর, ৯টি বাণিজ্যিক খামারে (হিজলগাড়ি, বেগমপুর, ফুরশেদপুর, ঝাঝরি, আড়িয়া, ফুলবাড়ি, ছয়ঘরিয়া, ঘোলদাড়ি ও ডিহি) জমির পরিমান ৩ হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর ও শশ্মান ১ দশমিক ২৭ একর। ২০১৫-১৬ রোপণ মরসুমে মিলজোন এলাকায় ৭ হাজার ৬শ ২০ একর জমিতে আখ চাষা করা হয়েছিলো। ২০১৬-১৭ রোপণ মরসুমে ৫ হাজার ৬শ ৪৬ একর জমিতে আখচাষ করা হয়েছে। গত মরসুমের তুলনায় ১ হাজার ৯শ ৭৪ একর জমিতে আখচাষ কম হয়েছে। শুধু চাষিদের জমিতে আখচাষ কম হয়েছে তা নয় কেরুজ নিজেস্ব জমিতেও আখচাষ কম হয়েছে। চিনিকলের কাঁচামাল হচ্ছে আখ। আর আখচাষ করে থাকে এলাকার আখ চাষিরা। তাই আখ চাষিদের চিনিকলের প্রাণ হিসেবে ধরা হয়। চাষিদের অনেকেরই অভিযোগ চিনিকলের কোনো কোনো কর্মকর্তার আচরণের কারণে আখচাষ কম হয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আখচাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সভাসমাবেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার প্রচারণা চালালেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। চাষিদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ ৭৯ বছর পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিনিকলের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিজেস্ব জমি অথবা লিজ নিয়ে হলেও ২ হাজার একর জমিতে আখ লাগাতে হবে। জনশ্রুতি রয়েছে যারা আখ লাগাবে না তাদেরকে এ মিল থেকে অন্যত্র বদলি করা হবে। আখচাষ করতে যে খরচ হতো সেই টাকা দিয়ে সেখানে ঘরভাড়া করে পরিবার পরিজন নিয়ে চাকরি করতে হবে। মিলের স্বার্থে এমন কঠোর সিদ্ধন্ত শ্রমিক কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ায় তা নিয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে চাঁপাক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে চিনি কলের কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সভাসমাবেশের ফলাফল তা হলে কী শূন্য? আখচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী বিশ্বাস বলেন, ২০১৬-১৭ রোপণ মরসুমে আখচাষ হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো সভাসমাবেশে চাষিদেরকে নিয়ে বাজে মন্তব্য এবং বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত আচরণ সন্তোশজনক ছিলো না। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসে আমাদেরকে নিয়ে বসেছেন। তার আচরণে চাষিকূল সন্তুষ্ট। আশা করি আগামীতে আখচাষ বৃদ্ধি পাবে।
অবসরে যাওয়া কয়েকজন শ্রমিক জানান, এক সময় এ প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সে সময় আমাদেরকে দেয়া হতো রেশন, পোশাক, জুতা, ছাতা, লাইট, নানা ছুটির পয়সা। সে সবের আজ বালাই নেই। সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিকের জায়গায় আজ ১৩শ শ্রমিক। সেই জমি সেই মিল তার পরও লোকশান আর লোকশান। প্রধান গলদটা কোথায়? কেন চিনিকলটিকে টিকিয়ে রাখতে এত টেনশন পোয়াতে হয় অনেককে। চিনিকলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এনায়েত হোসেন বলেন, এতদা অঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সকলের সহযোগিতা চাই। এ নিয়ে কাদা ছোড়া ছুড়ি না। কারণ এ প্রতিষ্ঠানে অনেকেরই রুটি রুজি হয়ে থাকে। আর কারো আচরণ আসলে মেন টু মেন ভেরি করে থাকে।