হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম না থাকায় একের পর এক মৃত্যু ॥ আতঙ্ক

চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে চরম সাপ আতঙ্ক ॥ একই রাতে সর্পদংশনে তিনজনের মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার: স্টেশনারির খুদে চাকুরে সজিবকে (১৭) দ্রুত হাসপাতালে নিয়েও এন্টিস্নেক ভেনম না থাকায় যেমন বাঁচানো যায়নি, তেমনই হাসপাতালে নেয়ার আগে ওঝার ঝাড়ফুঁকের পর হাসপাতালে নিয়ে দ্রুত এন্টিস্নেক ভেনম কিনেও সুস্থ করা যায়নি কলেজছাত্রী স্বপ্নাকে (১৯)। দু প্রান্তের দুজনকে গতপরশু রাতে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় সাপে কাটে। এদিকে একের পর এক সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে নিয়েও সুস্থ করতে না পারায় সাপে কাটা অন্য রোগীদের ওঝা কবিরাজের নিকট নিয়ে ছুটছে বলে গতরাতে খবর পাওয়া গেছে। ফলে আতঙ্কগ্রস্ত না হাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া মেহেরপুর গাংনীর চরগোয়ালগ্রামের কৃষক ইয়ার আলীকে একই রাতে সাপে কাটে। তাকে ঝাড়ফুঁকের পর কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায়।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সিঅ্যান্ডবি মাদরাসাপাড়ার বাসিন্দা সজিব গতপরশু ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো। রাত ১টার দিকে তার ডান বাহুতে সাপে দংশন করে। যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙে। তাকে দ্রুত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা দেখেই নিশ্চিত হন, বিষধর সাপে কেটেছে। বিষও প্রয়োগ করেছে প্রচুর। হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম না থাকায় দ্রুত তা বাইরে থেকে কিনে আনতে বলেন। রোগীর নিকটজনেরা হাসপাতাল এলাকায় মেসার্স মামুন মেডিকো খোলা পেয়ে এন্টিস্নেক ভেনম আছে কি-না জানতে চান। ওষুধের দোকান থেকে বলা হয়, আছে তবে তা বেলগাছি থেকে আনতে হবে। নগদ ১০ হাজার টাকা লাগবে। নগদ অতো টাকা তাৎক্ষণিক কাছে না থাকায় মোটরসাইকেল জিম্মায় রেখে ওষুধ দিতে অনুরোধ করেন। তাতে সাড়া না দিলে অথই সাগরে পড়েন রোগীর লোকজন। তারা রাতে ছোটাছুটি করে টাকা জোগাড় করতে বেজে যায় সাড়ে ৩টা। ওই দোকানির নিকট তা দিলে তিনি পাশেরই মতিন ফার্মেসি খুলিয়ে ওষুধ নিয়ে দেন। এদিকে সময় গড়িয়ে যায় অনেক। এন্টিস্নেক ভেনম নিয়ে চিকিৎসকের হাতে দেয়ার পর চিকিৎসক পুশ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী মারা যায়। রোগীর লোকজন ওই ওষুধের দোকানির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়লেও নিয়তি মেনে লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে। গতকালই দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এলাকায় চরমভাবে সাপ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত কয়েকজনকে রাতে ওঝার নিকট নিয়ে ঝাড়ফুঁক দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
অপরদিকে মেহেরপুর গাংনীর ষোলটাকা ইউনিনের সড়াবাড়িয়া গ্রামের হাসানুজ্জামান সুমনের মেয়ে মেহেরপুর সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী শারমীন আক্তার স্বপ্নাকে গতপরশু রাত ১টার দিকে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় হাতে দংশন করে বিষধর সাপ। তাকে নেয়া হয় হেমায়েতপুর বাজারের ওঝার কাছে। ঝাড়ফুঁক আর কাটা ছেড়ার নাটক করতেই বেজে যায় সকাল ৮টা। সকাল ৯টার দিকে তাকে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। না, স্বপ্নার জন্য এন্টিস্নেক ভেনম বাইরে থেকে নিতে বিলম্ব হয়নি। হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম না থাকার কথা শুনে তার নিকটজনেরা ছুটে যান হাসপাতাল এলাকারই লাইফ কেয়ার ফর্মেসিতে। সেখানে গিয়ে ওষুধের দাম শুনে যখন রোগীর লোকজন বলেন ওতো টাকা এখন নেই। তা শুনে দোকানি বলেন, আগে রোগী বাঁচান পরে দেন দাম। এন্টিস্নেক ভেনম নিয়ে স্বপ্নার শরীরে পুশ করার পরও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসক বলেছেন, হাসপাতালে রোগীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেয়া হয়েছিলো।
মেহেরপুর গাংনীর স্বপ্নাকে না হয় ওঝার কাছে নেয়ার কারণে বিলম্বে হাসপাতালে নেয়া হলো, চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের সিঅ্যান্ডবি মাদরাসাপাড়ার রবিউল ইসলামের ছেলে খাতুন স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধি সজিবকে? তাকে তো দ্রুতই হাসপাতালে নেয়া হয়, তার জন্য এন্টিস্নেক ভেনম কিনতে গিয়ে বিলম্ব হয়েছে অনেক। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম না থাকার কারণে একের পর এক রোগীর প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ার বিষয়টি আরএমও ডা. শামীম কবির আংশিক স্বীকার করে বলেছেন, পূর্বে চাহিদাপত্র খতিয়ে দেখে নতুন করে তা প্রণয়নপূর্বক আমরা দ্রুত বরাদ্দ নেয়ার চেষ্টা করছি। জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে এন্টিস্নেক ভেনম বরাদ্দ না পাওয়ার বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। দু দিন আগে বুজরুকগড়গড়ি মাদরাসাপাড়ার ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নাজমা খাতুনকেও এন্টিস্নেক ভেনমের জন্যই মূলত বাঁচানো যায়নি। যদিও তাকে হাসপাতালে নিতে তার নিকটজনেরা কিছুটা বিলম্ব করেছিলেন। হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর সুচিকিৎসা না থাকায় স্বাস্থ্য সচেতন মহলে বেড়েই চলেছে ক্ষোভ।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের এই চিকিৎসক ডা. শামীম কবিরই এন্টিস্নেক ভেনম গুদাম থেকে বের করে বহু রোগী বাঁচিয়েছেন। সাপে কাটা রোগীর সুচিকিৎসার প্রতীক হিসেবে সদর হাসপাতালকে দাঁড়া করাতে অনেকটাই সক্ষম হন। সেই তিনি এখন আরএমও। অথচ এখন এন্টিস্নেক ভেনম না থাকার কারণে হাসপাতালে রোগী নিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। ফলে হাসপাতালের ওপর চরম আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ওঝা করিবরাজে। গতকাল চুয়াডাঙ্গা সিঅ্যান্ডবি ও পলাশপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় চরম সাপের আতঙ্ক ছাড়ায়। আতঙ্কগ্রস্ত কয়েকজন হিস্ট্রোরিয়ায় আক্রান্ত হলে নেয়া হয় ওঝার কাছে। তবে প্রকৃত বিষধর সাপে সত্যিই কতোজনকে কেটেছে তা নিশ্চিত করে জানা সম্ভব হয়নি।
গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, একই রাতে মেহেরপুর গাংনীর চরগোয়ালগ্রামের কৃষক ইয়ার আলীকে সর্পদংশন করে। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় কানে সাপে দংশন করে। স্থানীয় ওঝার ঝাড়ফুঁকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে নেয়া হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল রোববার দুপুর একটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইয়ার আলীর মৃত্যু হয়।