নতুন শিক্ষা আইনেও কোচিং বাণিজ্যের ফাঁদ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: কয়েক দফা সংশোধন ও পেছানোর পর নতুন করে আবারও শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হলেও এতে কোচিংবাণিজ্যের ফাঁক রয়েই গেছে। তাই এই খসড়া চূড়ান্ত হলে এ অপতৎপরতার ফাঁদ স্থায়ীভাবে বৈধতা পাবে বলে শিক্ষাবিদরা জোরালো আশঙ্কা করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন আইনের খসড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ এর বিতর্কিত ২নং ধারাটি হুবহু রাখা হয়েছে। যা কৌশলে শিক্ষকদের বৈধভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেই কোচিং করানোর সুযোগ করে দেবে।

নতুন আইনের খসড়া পাস হলে গাইড বই ও শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলা বন্ধের মতো ইতিবাচক দিক থাকলেও তা শিক্ষকদের কোচিং বা টিউশনি করানো থেকে বিরত রাখতে পারবে না। বরং ভিন্ন সঙ্গায়নের আলোকে বৈধভাবেই কোচিং করানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে; থাকবে টিউশনিরও সুযোগ। প্রস্তাবিত এই আইনে একটি তফসিলসহ ৫১টি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৩ পৃষ্ঠার এ আইনের খসড়ার ২৪নং ধারার ৩নং উপধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের লিখিত সম্মতি নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবে। যা ২০১২ সালে প্রণীত ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ এর বিতর্কিত ২ ধারারই অংশ। এছাড়া ওই নীতিমালার সবচেয়ে বিতর্কিত তিন নং ধারা বাতিল হবে কিনা সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি মন্ত্রণালয়। বিতর্কিত দুই নং ধারায় বলা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান চলাকালে কোনো শিক্ষক কোচিং করাতে পারবেন না। তবে- ওই ধারার ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধুমাত্র অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। ‘খ’ উপ-অনুচ্ছেদে শহরভেদে এ জন্য বিষয় প্রতি ৩০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়ারও বৈধতা রয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, কিছু অভিভাবক সবসময়ই থাকবে যারা তাদের সন্তানদের ক্লাসের বাইরেও অতিরিক্ত পড়ানোর কথা চিন্তা করবেন।

 

এছাড়া অতিরিক্ত ক্লাসের এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষকরাও শ্রেণিকক্ষে ভালোভাবে না পড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাসে (কোচিং সমতুল্য) শিক্ষার্থীদের টানার চেষ্টা করবেন। এরই মধ্যে শিক্ষকরা নীতিমালার এ অংশের সুযোগ নিয়েছেনও। এ অবস্থায় আইনে এ সুযোগ রাখলে তা বৈধভাবে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিদ্যালয়েরই চেয়ার, টেবিল, বিদ্যুত ব্যবহার করেই শিক্ষকদের কোচিং করানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। যা সব শিক্ষার্থীকেই কোচিংয়ে আসতে বাধ্য করবে।
শিক্ষাবিদরা আরও বলেন, শিক্ষকদের বেতন দিয়ে শিক্ষকতা করানো হয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য। যদি কোনো শিক্ষার্থী ভালো না বোঝে সে ক্ষেত্রে ক্লাসের মধ্যেই তাদের চিহ্নিত করে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে বোঝানোর দায়িত্ব ওই ক্লাসের শিক্ষকেরই। কিন্তু এর বাইরে আবার অতিরিক্ত ক্লাস করানোর সুযোগ রাখা ও তার বিনিময়ে বিষয় প্রতি ৩০০ টাকা নেয়ার বিধান অমানবিক। এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই যদি অতিরিক্ত ক্লাস প্রয়োজন হয় তবে তা অতিরিক্ত অর্থ ছাড়াই বা সরকারি খরচে করাতে হবে। কারণ এক বিষয়ে ৩০০ টাকা দিয়ে পড়তে গেলে সব বিষয় মিলে খরচের অংকটি অনেক বড় হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের মানুষের বড় অংশই এখনো যেহেতু দারিদ্র্যসীমা বরাবর ও তার নিচে অবস্থান করছে সেহেতু এ খরচ বহন তাদের জন্য অসম্ভব। একই সঙ্গে এটি শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যেরও সৃষ্টি করবে বলে মত তাদের। যারা ধনী তারা এ সুযোগে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস করে ভালো ফল করবে। আর যারা গরিব তারা অতিরিক্ত টাকাও দিতে পারবে না, ক্লাসও করতে পারবে না। এর ফলে তাদের ফলাফল অতিরিক্ত ক্লাস করাদের তুলনায় খারাপ হতে বাধ্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের বৈষম্যমূলক আইনকে তাই ভালোভাবে নিতে পারছেন না শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা।
২০১২ সালে প্রণীত নীতিমালার তিন নং ধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমোদন নিয়ে বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (দশ জন পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদের টিউশনি করানোর কথাও উল্লেখ আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যায়যায়দিনকে জানানো হয়, পূর্বের নীতিমালা আইন তৈরি হওয়ার পরেও বহাল থাকবে। ফলে এর মধ্য দিয়ে শিক্ষকরা কোচিং করানোর পাশাপাশি অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষার্থীকেও পড়াতে পারবেন। পার্থক্য থাকবে এটুকুই যে অতীতে শিক্ষকরা বাইরের কোচিংয়েও ক্লাস নিতে পারতেন। এখন বিদ্যালয়ের ভেতরেই সে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের মতামত পাওয়ার পর খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন আনুষঙ্গিক কিছু কাজ করে শিগগিরই খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (আইন) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন যায়যায়দিনকে খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এ মাসের মধ্যেই অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই এটি মন্ত্রী পরিষদে উঠবে।
নতুন আইনের খসড়ায় কোচিং করানোর যে ফাঁকফোকর রয়ে গেছে সে সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সরকারি মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বিষয়টি মাথায় রেখে অতিরিক্ত ক্লাস করানোর এ সুযোগ রাখা হয়েছে। এখানে অভিভাবকদের আবেদনের বিষয়টিও রয়েছে। ফলে চাইলেই সবাইকে কোচিং করানোর সুযোগ থাকবে না।’
নীতিমালার তিন নং ধারাটি (বাইরের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো) আইন তৈরি হওয়ার পর আর থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মুফাদ আহমেদ বলেন, ‘নীতিমালা ও আইন একই সঙ্গে থাকবে। তবে আইন যেহেতু সংসদ কর্তৃক পাস সেহেতু সেটি অগ্রাধিকার পাবে। ফলে আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু নীতিমালায় থাকলে তা বাদ দিয়ে নীতিমালা আপডেট করা হবে। তবে সেটি আইন তৈরি হওয়ার পরে দেখা যাবে।’
অতিরিক্ত সচিবের বক্তব্য অনুসারে ২নং ধারা অব্যাহত থাকলেও তিন নং ধারা পরিবর্তন হতে পারে। তবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়ার পর ২০১১ সালে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়ন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ছয় বছর পর আইনের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি করে। গত বছরের ডিসেম্বরে খসড়াটি মন্ত্রী পরিষদে পাঠানো হয়। কিন্তু সে খসড়াতেও কোচিং, নোট, গাইডের সুযোগ থাকায় সে সময়ে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। প্রায় নয় মাস পর খসড়াটি আরও পর্যালোচনা করে এবারও যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতেও কোচিং-টিউশনির পরোক্ষ সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন অভিভাবক ও বিশ্লেষকরা।
খসড়ায় ইতিবাচক দিকসমূহ: কোনো ধরনের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা এ আইনে দ-নীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। নোট-গাইড ক্রয় বা পাঠে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনে সহায়তা করলে বা প্রশ্নপত্র ফাঁসে সহায়তা করা গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের ফি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। উচ্চশিক্ষা স্তরের সব পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বেতন ও ফি সরকারের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন করে নিতে হবে। সব শিক্ষার্থী অভিন্ন গ্রেডিং ব্যবস্থায় মূল্যায়িত হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ বিধি থাকবে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এসবের প্রত্যেকটি লঙ্ঘনের জন্য রয়েছে জরিমানা, বেতন বন্ধ, প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল, জেল বা জেল-জরিমানার মতো কঠোর শাস্তির বিধান।