রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে মিয়ানমার সরকার দোষী সাব্যস্ত

মাথাভাঙ্গা মনিটর: রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্থায়ী গণআদালত গতকাল শুক্রবার এই প্রতিকী রায় ঘোষণা করেছেন। একইসাথে মিয়ানমারে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে অবিলম্বে দেশটির ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি, মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাব জব্দ, মিয়ানমারের বাইরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারিসহ মোট ১৭ দফা সুপারিশ করেছেন এই আদালত। মালয়েশিয়াভিত্তিক দ্য স্টার অনলাইনের খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সাত সদস্যের বিচারক প্যানেল এই রায় ঘোষণা করেন। তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০০ নির্যাতিত মানুষের সাক্ষ্য, ডকুমেন্টারি এবং বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা করে এই রায় ঘোষণা করেছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ইন্টারন্যাশনাল পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালে এই বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে গঠন করা এই ট্রাইব্যুনালে গত পাঁচ দিন ধরে টানা শুনানি চলে। গতকাল প্রধান বিচারক ড্যানিয়েল ফিয়েরেস্টেইন এই রায় পড়ে শোনান। যিনি আর্জেন্টিনার সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা। ফিয়েরেস্টেইন বলেন, মিয়ানমার সরকার গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীকে কাচিন ও মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোর জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। অন্য বিচারকরা হলেন- মালয়েশিয়ার জুলাইহা ইসমাইল, কম্বোডিয়ার আইনবিদ হেলেন জার্ভিস, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান জিল এইচ বোয়েরিঙ্গার, ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী নুরসিয়াবানি কাতজাসুংকানা, ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী সাদি সদর ও ইতালির সুপ্রিম কোর্ট অব ক্যাসেসনের বর্তমান সলিসিটর জেনারেল নিলো রেসি।

বিচারক গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার কয়েকটি সুপারিশ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে মিয়ানমারকে মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার তথ্য জানতে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান দলকে অবশ্যই সে দেশে ভিসা এবং সহজে প্রবেশাধিকার দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ও নাগকিত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক বিলোপ করে মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

বিচারক গিল বোয়েরিঙ্গার আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহিংসতার মুখে প্রাণভয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া দেশ যেমন বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়াকে অবশ্যই আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। ট্রাইব্যুনালের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য, রায় এবং সুপারিশ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মহল এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে প্রদান করা হবে যাতে সেগুলো মেনে চলার জন্য তারা মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিতে পারে।

রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এই গণআদালতের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান চন্দ্র মুজাফফর। তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক, বিশেষজ্ঞ সাক্ষীদের মতামত, ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য, বিশ্লেষণ করে দেওয়া এ রায় মিয়ানমার যে ধরনের অপরাধ করছে তা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এ গণআদালত গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের চিহ্নিত করেছে। মিয়ানমারের নৃশংসতা অপরাধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোট ও প্রতিষ্ঠান যেমন- আসিয়ান, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও পরাশক্তিধর দেশগুলো এ গণআদালতের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য এবং রায়কে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্ট্যাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটনও জবানবন্দি দেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালিয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। এ অভিযোগের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোনোও নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক গণআদালতে বিচারের মুখোমুখি হন। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও শুনানিতে অংশ নেন।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পরার পর এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের হিসেবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। দেশটি ছেড়ে পালাতে গিয়ে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে একশ’র বেশি রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ। আহত অবস্থায় বাংলাদেশে এসে চিকিত্সা নিয়েছে বেশ সংখ্যক রোহিঙ্গা। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ এ সহিংসতাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর অস্ত্র বিক্রিসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহবান জানিয়েছে। সম্প্রতি এ ঘটনা ট্রাইব্যুনালের বিচারকে বেগবান করেছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে ইতালিতে ৬৬ জন আন্তর্জাতিক সদস্য নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানবাধিকার এবং গণহত্যার সাথে জড়িত অনেক মামলা নিয়ে ৪৩টি অধিবেশন হয়েছে এ ট্রাইব্যুনালে। যদিও প্রতীকী বিচারের রায় মানার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই দায়ী রাষ্ট্রগুলোর।

আদালতের করা ১৭ দফা সুপারিশের মধ্যে আরো আছে- মিয়ানমার সরকার এবং আসিয়ান প্রতিনিধিরা রাখাইনের সকল সশস্ত্র গ্রুপকে নিয়ে একটি অস্ত্রবিরতির প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা শুরু করবে, অং সান সু চির ঘোষিত যাচাই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাসহ সব গোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিকত্ব দিতে হবে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থাকে রাখাইনের ঘটনা তদন্তের অনুমতি দিতে হবে, মিয়ানমারের পার্লামেন্টে সামরিক প্রতিনিধির কোটা বাতিল করতে হবে, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশকে পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে আনতে সংবিধানে নিশ্চয়তা থাকতে হবে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের দায়মুক্তি না দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি ও সেনাবাহিনীকে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র: রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি ও দেশটির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের চাপ দেয়া হচ্ছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিকি হ্যালি বৃহস্পতিবার একথা জানিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শুধু তাকে (সু চি) চাপ দিচ্ছি না, আমরা দেশটির সেনাবাহিনীকেও চাপ দিচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ চেয়ারম্যান জোসেফ ডানফর্ড মিয়ানমারের সেনাপ্রধানে সাথে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এমন অবস্থা চলতে পারে না। এর আগে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের দৃঢ় ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনও বলেছেন, মিয়নমারকে অবশ্যই সেনা অভিযান বন্ধ করতে হবে।

Leave a comment