মিয়ানমারে ত্রাণবাহী নৌকায় পেট্রোলবোমা হামলা

রোহিঙ্গা সংকট জাতিসংঘে সু চি বক্তব্যই ভাইস প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে : বাড়িঘরে আগুন : সীমান্তে কাঁটাতারে বিদ্যুত্ সংযোগ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: মিয়ানমারের রাখাইনে রেডক্রসের ত্রাণবাহী একটি নৌকায় পেট্রোলবোমা হামলা হয়েছে। গত বুধবার রাতে রাখাইনের রাজধানী সিতে’তে এই হামলার ঘটনা ঘটে। ত্রাণগুলো শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হবে এমন ধারণা থেকে এই হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা নৌকাটির দিকে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারে। এক পর্যায়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং কয়েকজনকে আটক করে। ত্রাণবাহী নৌকাটিতে প্লাস্টিক সিট, বালতি এবং মশারিসহ প্রায় ৫০ টন ত্রাণ ছিলো।

এদিকে জাতিসংঘে মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট দেশটির কার্যত সরকার প্রধান অং সান সু চি’র নির্জলা মিথ্যাচারের পুনরাবৃত্তি করেছেন। অন্যদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া থামেনি। বাংলাদেশের ভেতর থেকে সীমান্তের ওপারের বাড়িঘরে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এমনকি মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারে বিদ্যুত্সংযোগ ও নতুন করে ল্যা্ল মাইন পোঁতা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এক খবরে বলা হয়েছে, সিতে’তে বুধবার রাতে যখন আন্তর্জাতিক কমিটি অব রেডক্রস বা আইসিআরসি’র ত্রাণ নৌকায় তোলা হচ্ছিলো তখন সেখানে প্রায় তিনশোর মতো মানুষ জড়ো হয়। তাদের হাতে ছিলো লোহার রড ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। তারা রেডক্রসের নৌকাটি ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে তারা ত্রাণবাহী নৌকায় হামলা চালায় এবং পেট্রলবোমা ছুঁড়ে মারে।

মিয়নামার সরকার বলেছে, কয়েকশো বিশৃঙ্খল মানুষ বেশ আগ্রাসী হয়ে উঠে এবং নৌকায় ত্রাণ তুলতে বাধা দিচ্ছিল। এ সময় প্রায় দুইশো পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। মিয়ানমার সরকারের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, উত্তেজিত জনতা ভেবেছিলো এ সাহায্যগুলো শুধু ‘বাঙালিদের’ জন্য পাঠানো হচ্ছে। আইসিআরসি’র একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, হামলার ঘটনায় কোনো ত্রাণকর্মী আহত হননি।

খবরে বলা হয়েছে, ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে প্রাণ বাঁচাতে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে কিংবা যারা এখনো রাখাইনে আছে তাদের সবার ত্রাণ সহায়তা দরকার। কিন্তু রাখাইন অঞ্চলে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান অবস্থান করছে তাদের জন্য ত্রাণ পাঠানো মোটেও সহজ কাজ নয়। রাখাইনে ত্রাণ সংস্থার কাজের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা যেমন আছে তেমনি স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরাও চায় না যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য ত্রাণ পাঠানো হোক। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়নে স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা সেনাবাহিনীকে সহায়তা করছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে।

সু চি বক্তব্যই জাতিসংঘে বললেন ভাইস প্রেসিডেন্ট: আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নিজেদের অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেনি মিয়ানমার। জাতিসংঘে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ভ্যান থিও জানিয়েছেন, রাখাইন থেকে হঠাত্ করে কেন অংসখ্য মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে সে বিষয়টি সরকার তদন্ত করে দেখছে। একইসঙ্গে নিরীহ বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি এড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে জাতিসংঘের চলতি সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেননি দেশটির কার্যত সরকার প্রধান অং সান সু চি। কিন্তু তার প্রতিনিধিত্বকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট থিও মূলত দুই দিন আগে দেওয়া সু চি’র বক্তব্যই উগড়ে দিয়েছেন। সু চি তার প্রতীক্ষিত বক্তব্যে রাখাইনের সহিংসতা ও রোহিঙ্গা সংকটকে ছোট ইস্যু হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করেন। ভ্যান থিও তার বক্তব্যে বুধবার বলেন, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে মানুষদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনায় মিয়ানমার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি দাবি করেন, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বেশিরভাগ মুসলমানরা এখনো রাখাইনেই অবস্থান করছেন। সু চিও তার বক্তব্যে একই দাবি করেন। সুচি তার বক্তব্যে পালিয়ে আসা মানুষদের রোহিঙ্গা বলে উল্লেখ করেননি। তার সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্টও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি।

রাখাইনে বাড়িঘরে আগুন দেয়া চলছেই: ঘুমধুম সীমান্ত থেকে আজহার মাহমুদ জানান, গত দুইদিন ধরে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার হার কমে যাওয়ায় অনেকে ভেবেছিলেন সেনাবাহিনীর অভিযান হয়তো বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সীমান্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ভিন্ন তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশ সীমানার ভেতর থেকেই নতুন পোড়া বাড়ি, সদ্য লাগানো আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এছাড়া সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতার দিয়ে সেখানে বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া ও সীমান্তে ল্যান্ডমাইন পোঁতারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি একটি পয়েন্টে গিয়ে বাংলাদেশের দিকে সাবমেশিনগান তাক করে অবস্থান নিতে দেখা গেছে মিয়ানমার সৈন্যদের। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে উখিয়ার থ্যাইংখালীতে নতুন করে স্থাপিত আশ্রয় শিবিরের পূর্বাংশের সর্বোচ্চ উঁচু পাহাড়ে উঠে দেখা যায়, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঢেকিবুনিয়া গ্রামের তিনটি বাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া উড়ছে। সেগুলো নিভে আসতে আসতে আরো একটি বাড়ি থেকে নতুন করে ধোঁয়া বেরুতে দেখা যায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত পাঁচদিন আগে বুথিদং থেকে পালিয়ে আসা হাফেজ আবদুর রহমান জানান, কিছু সময় আগেই ওই জায়গায় তারা দুইবার হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখেছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তারপর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। দুপুর দেড়টার দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নাইক্ষংছড়ির জলপাইতলী এলাকায় মিয়ানমার সীমান্তের দেড়’শ মিটারের মধ্যে পৌঁছে দেখা যায়, ওই এলাকার সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে আটজন শ্রমিক। সেখানে একজন সেনাকে হাফপ্যান্ট পরে কাজ তদারকি করতে দেখা যায়।

একই সময়ে এর কিছুটা অদূরে একটি ছোট পাহাড়ের উপর কিছুটা জঙ্গলঘেরা জায়গায় দুটি পৃথক স্থানে দুই সেনাকে বাংলাদেশের দিকে সাবমেশিনগান তাক করে থাকতে দেখা যায়। জলপাইতলীর পাশ্ববর্তী নাইক্ষংছড়ির তমব্রু এলাকার শুরুতেই সীমান্তের দুইশ মিটার দূর থেকে ওপারে পাশাপাশি দুটি বাড়ি পুড়ে যাওয়া এবং পুড়ে যাওয়া উঁচু নারিকেল গাছ দেখা গেছে। স্থানীয় একজন বাসিন্দা আরাফাত হোসেন ইত্তেফাককে বলছিলেন, গত বুধবার রাতে তাদের গ্রাম থেকে ওই এলাকায় আগুন জ্বলতে দেখেছেন তারা।

এর কিছুক্ষণ পর তমব্রু এলাকার জিরো পয়েন্টে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়া বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে কথা হয়। তারা জানায়, তমব্রুর মিয়ানমার অংশে সেনারা এখন সার্বক্ষণিক থাকে না। তবে প্রতিদিন দিনের যে কোনো সময় তারা ৫০/১০০ জনের দল নিয়ে শোডাউন করে যায়।

তমব্রু এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার উল্ল্যাহ এ সময় ইত্তেফাককে জানান, তমব্রু গ্রামের বেশিরভাগ ঘর আগেই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, অথবা রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে পরে পোড়ানো হয়েছে। এখন যেসব ঘরগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোও পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। নতুন করে কাঁটাতার দেয়া হচ্ছে, ল্যান্ডমাইন পোতা হচ্ছে, যাতে কেউ পারাপার হতে না পারে। যেসব জায়গায় বিদ্যুত্ সংযোগ আছে, সেসব এলাকার কাঁটাতারে বিদ্যুতের লাইন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

এদিকে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের প্রধান মার্জুকি দারুসমান গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন যে, তারা সেখানে এখনো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের অনুমতি পাননি। এখনো পর্যন্ত কোনো গণমাধ্যমও স্বাধীনভাবে সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না। সেখানকার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে দিচ্ছেনা বলেও খবর পাওয়া গেছে।