রোহিঙ্গা নিয়ে সু চির বক্তব্য নির্জলা মিথ্যা

বিশ্ব নেতাদের সমালোচনা, সম্মাননা স্থগিত যুক্তরাজ্যের

স্টাফ রিপোর্টার: রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। তবে গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি কিছু বিষয় উত্থাপন করেছেন যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে সু চির বক্তব্য নির্জলা মিথ্যা। তার বক্তব্য সঠিক কি-না তা বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি সংবাদদাতা জোনাথন হেড। এদিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে সু চির বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের নেতারা। আর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞের জন্য সমালোচনার মুখে সু চিকে দেয়া সম্মানসূচক সদস্য পদ স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন ‘ইউনিসন’। খবর বিবিসি ও গার্ডিয়ানের।

ভাষণে সু চি বলেছেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে রাখাইনে কোনো সহিংসতা নেই। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শন করে জনাথন হেড বলছেন, ‘৭ সেপ্টেম্বর সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি মিডিয়া দলের অংশ হিসেবে আলেল থান খিয়াও শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে অটোমেটিক রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো এবং বড় ধরনের চারটি ধোঁয়ার লাইন দেখতে পাচ্ছিলাম যা নিশ্চিত ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যে গ্রামগুলো আগুনে পুড়ছে। এছাড়া আমরা যাই রোহিঙ্গা গ্রাম গাউ দু থার ইয়া, যেখানে সশস্ত্র পুলিশের সামনেই বৌদ্ধদের লাগানো আগুন তখনো জ্বলছিলো। পরে বাংলাদেশ থেকেও আমি নাফ   নদীর ওপারে আগুনের ধোয়া স্পষ্টই দেখতে পাই।’

সু চি তার ভাষণে বলেছেন, ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন আইনের বাইরে গেলে বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে জোনাথন হেড বলেন, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কিন্তু কখনোই কোনো সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সু চি তার ভাষণে বলেন, রাখাইনে সব মানুষের কোনো বৈষম্য ছাড়াই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার রয়েছে। এ বিষয়ে জোনাথন বলেন, এটা নির্জলা মিথ্যা। রোহিঙ্গারা বহু বছর ধরেই বৈষম্যের শিকার। এমনকি তাদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত। বিয়ে করতেও অনুমতি নিতে হয়, আবার সে অনুমতির জন্য ঘুষও দিতে হয়। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে তাদের ওপর বিধিনিষেধ আরও জোরদার করা হয়। অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে মিয়ানমারের মধ্যেই ক্যাম্পে অবস্থান করে। আমি জানি ক্যাম্পের শিশুগুলোর পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো পাঁচ বছরের জন্য। চার বছর আগে আমি একটি রোহিঙ্গা গ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সহিংস আচরণের জন্য রোহিঙ্গাদের চিকিত্সা নিতে যাওয়াও অসম্ভব ছিলো।

বিশ্ব নেতাদের সমালোচনা: মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি যে ভাষণ দিয়েছেন তার সমালোচনা করেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সু চিকে ফোন করে বলেছেন যে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দিকেও নজর দিতে হবে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, রাখাইনে সামরিক অভিযান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মানবিক সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জাতিগত নিধন বন্ধে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, সহিংসতা বন্ধ করে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য তারা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে একটি উদ্যোগ নেবেন।

যতক্ষণ না পর্যন্ত মিয়ানমারের ট্রাজেডির অবসান না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েফ এরদোয়ান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-ও রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করার কথা বলছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে সমর্থন করায় সু চির সমালোচনা করেছেন। আর যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সু চির সমালোচনা করে বলেছে তিনি বালিতে মাথা গুঁজে আছেন।

সু চিকে দেয়া সম্মাননা স্থগিত: মিয়ানমারের কার্যত সরকার প্রধান সু চিকে অতীতে দেওয়া সম্মাননা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন ‘ইউনিসন’। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম অত্যাচার বন্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক সদস্যপদ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। ‘ইউনিসনে’র ওয়েবসাইটে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য ব্যবস্থা নিতে সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় সু চি কারাবন্দি থাকাকালে ‘ইউনিসন’ ২০০৯ সালে তাকে এই সম্মাননা দিয়েছিল। নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইউনিসনের সভাপতি মার্গারেট ম্যাককি ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই আতঙ্কজনক। এ অবস্থায় সু চির ইউনিসনের সম্মানিত সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক চাপের প্রতি তিনি সাড়া দেবেন।’

এদিকে যুক্তরাজ্যের আরো কিছু প্রতিষ্ঠান সু চিকে দেওয়া পুরস্কার বাতিলের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। গত ৩০ বছরে সু চিকে গ্লাসগো, ব্রিস্টল, বাথ এবং কেমব্রিজ-সহ যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিগ্রি দিয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি শহর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও তাকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিও সু চিকে দেওয়া সম্মাননা স্থগিত করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির একজন মুখপাত্র বলেন, ১৯৯৮ সালে সু চিকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেন তারা। তখন সু চি মিয়ানমারে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিগ্রির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের স্টুডেন্টস ইউনিয়নও জানিয়েছে যে তারা সু চির সম্মানিত প্রেসিডেন্ট পদ প্রত্যাহার করে নেবে।

অক্সফোর্ড শহর কর্তৃপক্ষ ১৯৯৭ সালে মিয়ানমারের এই নেত্রীকে যে ‘ফ্রিডম অব দি সিটি অব অক্সফোর্ড অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছিল, তা এখন প্রত্যাহার করার কথা ভাবছেন কাউন্সিলররা। অক্সফোর্ড কাউন্সিলের সদস্য জন ট্যানার অক্সফোর্ড মেইলকে বলেছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি যদি না বদলায়, তাহলে কাউন্সিলররা ওই সম্মাননা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।