গাংনীতে শিশু কন্যাকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যা

অনাথ-এতিম ও অভাবের সংসারের অভিশাপ

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী উপজেলা কসবা গ্রামে দুই বছরের শিশু কন্যাকে হত্যার পর এক মা আত্মহত্যা করেছেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে এই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- মা আদরী খাতুন (৩৫) ও তার মেয়ে সামিয়া খাতুন (২)। মা-মেয়ের মর্মান্তিক আত্মঘাতীর ঘটনায় এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া বিরাজ করছে।
আদরী খাতুন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার বড়গাংনী গ্রামের লোকমান হোসেনের স্ত্রী এবং কসবা গ্রামের মৃত কাবরান হোসেনের নাতি। এতিম-অনাথ আদরী খাতুন অভাবের তাড়নায় পারিবারিক কলহের জের ধরে মেয়েকে পানিতে ফেলে হত্যা করে নিজেই আত্মহত্যা করতে পারেন। তবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে মরদেহ ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে সপ্তাহখানেক আগে কসবা গ্রামে নানা-নানির বাড়িতে চলে আসে আদরী। সাথে ছিলো শিশুকন্যা সামিয়া। গতকাল দুপুরে বাড়ির লোকজনের অগোচরে ঘরের ছাউনির আড়াই শাড়ি পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। প্রতিবেশীরা তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেন। তখন শিশু সামিয়াকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে আদরীর নানাবাড়ির পাশর্^বর্তী হাজি আজিবার হোসেনের পুকুর থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে গাংনী থানার ওসি আনোয়ার হোসেন সঙ্গীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রাথমিক তদন্তে মেয়েকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যার বিষয়টি উঠে আসে। মা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হেফাজতে নেয় পুলিশ। এ বিষয়ে থানায় অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে।
আদরী খাতুনের নানি বয়োবৃদ্ধা কাঞ্চন খাতুন বলেন, সতীনের ছেলেমেয়েদের সাথে কলহের জের ধরে সপ্তাহখানেক আগে চলে আসে আদরী। সোমবার রাতে তার স্বামী এসেছিলেন। অনেক অনুরোধ করার পরেও আদরী ফিরে যাইনি। তবে স্বামীর সাথে তার গ-গোল কিংবা স্বামীর বিরুদ্ধে আদরীর কোনো অভিযোগ ছিলো না। মূলত পারিবারিক কলহ ও অভাবের তাড়নার জের ধরেই আদরী আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা করছেন তার নানি। স্থানীয়রা ধারণা করছেন, আদরী খাতুন মৃত্যুর আগে তার শিশুকন্যাকে পানিতে ফেলে দিতে পারেন। তার মতো কষ্ট যেন মেয়ের না হয় সেজন্য দুজনেই মারা যেতে পারেন বলেও ধারণা গ্রামবাসীরা।
পারিবারিক সূত্রে আরো জানা গেছে, ছোটবেলায় আদরীর মা-বাবা মারা যায়। নানা-নানি তাকে লালন-পালন করেছেন। দারিদ্রতার কারণে লেখাপড়া শিখতে পারেননি। অভাবের সাথে যুদ্ধ করেই নানা-নানি তাকে পালতেন। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রামের রবিউল ইসলামের সাথে আদরীর বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তার নাম রিয়া। পিতার সাথে বসবাস করে রিয়া। সে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। প্রথম স্বামীর সাথে ডির্ভোস হলে একই এলাকার বড়গাংনী গ্রামের লোকমান হোসেনের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। লোকমানের প্রথম স্ত্রীর ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। সতীনের ছেলেমেয়ের সংসারে ভালো ছিলো না আদরী। নানাবাড়ির মতো সেখানেও অভাব যেন পিছু ছাড়ছিলো না। দাম্পত্য কলহ না থাকলেও পারিবারিক কলহ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। এতে চরম অসহায়ত্ব তাকে পেয়ে বসে। মাসখানেক আগে নানার মৃত্যুর পর নানির সংসারেও আরও অভাব নেমে আসে।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, এতিম আদরী নানির বাড়িতেও ঠাঁই হচ্ছিলো না। দরিদ্র নানি সামান্য আয়ে খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করেন। অন্যদিকে স্বামীর সংসারে কলহ। জীবনের এই বিষাদ থেকেই সে চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে ধারণা প্রতিবেশীদের।
আদরীর নানির প্রতিবেশী কয়েকজন নারী বলেন, নানির বাড়িতে আশ্রয় নিলেও দু বেলা দু মুঠো ভাত জোটেনি। শিশুকন্যাকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েছিলেন আদরী। স্বামী তাকে বুঝিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। আরো কয়েকদিন পরে সে ফিরে যাবে বলে স্বামীকে কথা দেয়। আদরী ও সন্তানের ফিরে যাওয়ার আশ^াসে স্বামী বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু আদরী স্বামীর বাড়ির পরিবর্তে চলে যায় না ফেরার দেশে। মা-মেয়ের মর্মান্তিক এই মৃত্যুর ঘটনায় এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। নানিবাড়ির উঠোনে মা-মেয়ের মরদেহ পাশাপাশি রাখা হয়। তাদের একনজর দেখে চোখের পানি ফেলেন উৎসুক মানুষ। অভাবের তাড়নায় এই মৃত্যু যেন গোটা জাতিকেই নানা প্রশ্নের মধ্যে ফেলেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিত্তবান মানুষের সহযোগিতার হাত প্রসারিত থাকলেও কেন এই মৃত্যু? তা ভাবাচ্ছে সমাজের বিবেকবান মানুষের। এদিকে স্ত্রী ও মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও লোকমান হোসেন তাদের দেখতে আসেননি। এদের মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা হতে পারে এমন আশঙ্কায় লোকমান আত্মগোপন করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তিনি মোবাইলফোন ব্যবহার না করায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পেতেই আদরী আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। তবে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হবে। এ বিষয়ে পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। আদরীর স্বামী লোকমান পুলিশের সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি। তবে লোকমানের বিরুদ্ধে আদরীর নানার পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই।