মন্ত্রীর নির্দেশের পর কুষ্টিয়ার খাজানগরে এগ্রোফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডে অভিযান

রশিদের চালের মিল ফাঁকা : খালি হাতে ফেরত এলো টাস্কফোর্স

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে রশিদ এগ্রোফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডে অভিযান চালিয়েছে জেলা টাস্কফোর্স কমিটি। গতকাল রোববার বিকেল ৪টার দিকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নির্দেশের পরপরই ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। এর আগে গত সোমবার সেখানে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিলো। রশিদ এগ্রোফুডের মালিক আবদুর রশিদ বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।

ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের সাথে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম মেহেদী হাসান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইবাদত হোসেন, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমান, জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম, কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দীনসহ গোয়েন্দা ও থানার পুলিশ ছিলো। বিকেল ৪টার দিকে সদর উপজেলার আইলচারা ইউনিয়নের বল্লভপুরে রশিদ এগ্রোফুডের মিলে জেলার শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রবেশ করেন। এ সময় ডিসি-এসপি মিলের ১৩টি গুদামের মধ্যে দুটি গুদাম ঘুরে দেখেন। গুদামে ধানের মজুত সম্পর্কে মিলের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। এ সময় ধানের বস্তার স্তূপের ওপর ইউএনও, খাদ্য, বাজার কর্মকর্তারা উঠে যান। তারা ওপর থেকে সব দেখে ধান মজুতের একটা পরিমাণ নির্ধারণ করেন। পরে মিলের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে আবদুর রশিদকে মিলে আসতে বলেন। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আবদুর রশিদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাকে মিলে আসার জন্য মিলের কর্মকর্তাদের তাগাদা দিতে থাকেন। তবে মিলের কর্মকর্তারাও আবদুর রশিদের মিলে আসার ব্যাপারে কোনো কথা বলেন না। একপর্যায়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা মিলের ব্যবস্থাপককে আটকের জন্য ওসিকে বলেন।

বারবার চেষ্টা করেও আবদুর রশিদকে তার মিলে আনা বা পাওয়া যায় না। একপর্যায়ে তার ফোন বন্ধ পান জেলা প্রশাসক। তার বাড়ি ও কুষ্টিয়া শহরের কার্যালয়েও যোগাযোগ করেন। তাতেও কোনো কাজ হয় না। ডিসি ও এসপি উভয়ই মিলের কর্মকর্তাদের বলতে থাকেন, রশিদ সাহেবকে আসতে বলেন। কোনো সমস্যা নেই। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের মোবাইলে কথা হয়। মিলে ধান ও চাল মজুত নেই বলে মন্ত্রীকে দুজনই আশ্বস্ত করেন। মিলে দাঁড়িয়ে বিকেল ৫টার দিকে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এটা নিয়মিত তদারকি। এই এলাকায় ৩১টি অটোরাইস মিলসহ অন্তত ৪০০টি মিল রয়েছে। এটা দেশের অন্যতম বড় মোকাম। এ কারণে সারাদেশে চালের দামের প্রভাব পড়ে। সেটা তদারকি করতেই এখানেই আসা হয়েছে।

সূত্র জানায়, গতকাল রোববার সচিবালয়ে আটোমিল মালিক অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সাথে বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ অতিরিক্ত চাল মজুদের অভিযোগে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি রাইস কিং খ্যাত কুষ্টিয়ার আবদুর রশিদ এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নওগাঁ জেলার লায়েক আলীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। সচিবালয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল অনার্স অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের সাথে বৈঠককালে তিনি মোবাইলফোনে সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসি ও এসপিদের এ নির্দেশ দেন। বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে চাল সংকট কাটাতে দেশের কোথায় এবং কোন গুদামে চাল মজুদ আছে সে বিষয়টি জানতে চান বাণিজ্যমন্ত্রী। বৈঠকের একপর্যায়ে বাংলাদেশ চালকল সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলীর নাম উঠে আসে।

জানা গেছে, আবদুর রশিদের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় তাঁর চালের মিল ও গুদাম আছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই গুদামে অভিযান চালিয়ে অতিরিক্ত চাল মজুদের প্রমাণ পায়। এ সময় তাকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সম্প্রতি সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় দু লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ রাখা আছে রশিদের গুদামে এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া সদর এসিল্যান্ড সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স সদস্যরা আবদুর রশিদের গুদামে অভিযান চালায়। সেখানে টাস্কফোর্স টিম তার ১৩টি গোডাউনে বিপুল পরিমাণ ধান ও চাল মজুদের প্রমাণ পান। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের টাস্কফোর্স টিমের প্রধান সদর এসিল্যান্ড সাইফুল ইসলাম জানান, অবৈধ মজুদদারির মাধ্যমে আবদুর রশিদ প্রতিদিন অন্তত ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু মজুদদারির অভিযোগে রশিদকে গ্রেফতার না করে টাস্কফোর্স মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। সূত্র জানায়, অভিযানের পর চালকল মালিক সমিতির এই নেতা কুষ্টিয়ার গোডাউনগুলোতে রাখা বিপুল পরিমাণ ধান-চাল দেশের অন্যান্য গোডাউনে সরিয়ে ফেলেছেন।

বিষয়টি জানতে পেরে বাণিজ্যমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে নওগাঁর ডিসি ও কুষ্টিয়ার এডিসি ও দুই জেলার পুলিশ সুপারের (এসপি) সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি বলেন, রশিদের মতো মানুষকে কোন আইনে মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়? তিনি অতিরিক্ত চাল মজুদ করে যে অপরাধ করেছেন তাতে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা উচিত ছিলো। এ মুহূর্তে আবারও তার গুদামে অভিযান চালান। সেখানে মজুদ করা অতিরিক্ত চাল ও ধান জব্দ করে তাকে গ্রেফতার করুন।

হাবিবুর রহমান আরও বলেন, গুদামে ধান মজুত ও উৎপাদনের পর চাল অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে কি-না, সবকিছুই দেখতে আসা হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, গুদামে ধানের মজুত প্রয়োজনের তুলনায় একটু কম আছে। এসব তদারকির বিষয় বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রাখা হচ্ছে। তদারকির বিষয়টি নিয়মিত চলতে থাকবে। অন্য মিলেও যাওয়া হবে। পুলিশ সুপার এস এম মেহেদী হাসান বলেন, আশা করা যাচ্ছে চালের বাজার খুব অল্প সময়ের মধ্যে সহনীয় হয়ে আসবে।এর পরপরই ডিসি-এসপি সেখান থেকে কুষ্টিয়া শহরের দিকে চলে যান।

এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের বলেন, রশিদের মতো লোকের কোন আইনে মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি অতিরিক্ত চাল মজুদ করে যে অপরাধ করেছেন, তাতে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা উচিত ছিলো। এই মুহূর্তে আবারও তার গুদামে অভিযান চালান। সেখানে মজুদ করা অতিরিক্ত চাল ও ধান জব্দ করে তাকে গ্রেফতার করুন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, অতিরিক্ত মজুদ রাখলে মিল মালিকদের তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করা হবে। কারণ তারা সিন্ডিকেট করে বাজারে চাল সংকটের গুজব ছড়িয়েছে। তারাই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ষড়যন্ত্র করছে। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলীর গুদামেও অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এটা আমাদের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ। চালের ইস্যুটি ধৈর্যের চরম সীমায় পৌঁছেছে। এ সময় লায়েক আলী জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ করেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

এদিকে মাত্র দু দিনের ব্যবধানে আবারও কুষ্টিয়ায় চালের দাম কেজি প্রতি দুই থেকে পাঁচ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে যে মিনিকেট চাল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিলো এখন তা ৬৫ টাকা কেজি, ২৮ চাল ৫২ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬ টাকা, স্বর্ণা চাল ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে গত এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে কুষ্টিয়ায় চালের দাম চতুর্থ দফায় কেজি প্রতি সর্বনিম্ন ৮ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।