কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনকালে ৪০ দেশের কূটনীতিকদের আশ্বাস
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বিশ্বের অনেক দেশই পাশে থাকবে। গতকাল বুধবার অন্তত ৪০টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় একথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের একার নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশ একা এই মানবিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। যতো দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরাতে সবাই বাংলাদেশের পাশে থাকবে। এদিকে প্রতিনিধি দলের বিদায়ের পর পরই গতকাল বিকেলে মংডুর একটি গ্রামে আগুন দেয়ার খবর মিলেছে।
বিদেশি এই প্রতিনিধিদের কুতুপালংয়ে নিয়ে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ও সচিব শহীদুল হক। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন শাহরিয়ার আলম ও বিদেশি প্রতিনিধিদের কয়েকজন।
চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং কিয়াং বলেন, মিয়ানমার যেমন বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র, তেমনি বাংলাদেশও চীনের বন্ধু রাষ্ট্র। বাংলাদেশ যাতে এই সঙ্কট মোকাবেলা করে এর ভালো সমাধান বের করতে পারে সেজন্য আমরা মিয়ানমারের সাথেও কথা বলবো। নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত লিওনি মার্গারেটা বলেন, রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জীবন অনিশ্চিত এবং অমানবিক। এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আমরা (বিদেশি প্রতিনিধি দল) নিজ নিজ দেশে গিয়ে আলোচনা করবো। এ সময় তিনি মানবতার ডাকে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।
অপরদিকে ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা বলেন, এটা খুবই অমানবিক ব্যাপার। এখানে না এলে রোহিঙ্গাদের কষ্টের জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতো না। আমারা এই সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকবো। আশা কবি অন্য দেশগুলোও বাংলাদেশের ডাকে সাড়া দেবে।
এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতসহ বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূতকে আলাদা আলাদাভাবে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে দেখা যায়। পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, মানবতার যে ক্ষতি হচ্ছে তারা তা নিজ চোখে দেখছেন। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সরকারের সমস্যা তাদের নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু এরজন্য বাংলাদেশের উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা আমরা মোকাবেলা করছি। তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়াই এই সংকটের একমাত্র সমাধান। এ ব্যাপারে বিদেশি সকল প্রতিনিধির কাছ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আশা করছি, আজকে তারা দেখে যাওয়ার পর মিয়ানমারের উপর চাপ বাড়বে।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছেন কূটনীতিকরা। সাড়ে ১২টার দিকে উখিয়ার শিবিরে গিয়ে তারা সার্বিক অবস্থা পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধি দলে ৪০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রদূত, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত, হাই কমিশনার এবং জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার প্রধান ছিলেন। তারা নির্যাতিত কিছু রোহিঙ্গার সাথে কথা বলেন। ছোট্ট শিশুদের সাথে হাত মেলান। পরে তারা মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ঘুমধুম, তমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় স্থানীয় বিজিবি কর্মকর্তা সীমান্তের এপার থেকে দেখা মিয়ানমারের সহিংসতা সম্পর্কে প্রতিনিধি দলকে ধারণা দেন। তারা দু’-একজনকে স্বাধীনভাবে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলতেও দেখা গেছে। এ সময় তারা নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের খোঁজ-খবর নেন। তারা মিয়ানমার সরকারের এমন অভিযানের নিন্দা জানান।
প্রতিনিধি দলের বিদায়ের পর মংডুতে আগুন দিয়েছে সৈন্যরা: দুপুরের পর প্রতিনিধিরা কুতুপালং ছেড়ে কক্সবাজারের দিকে রওয়ানা দেয়ার পর পরই বিকেলের দিকে মংডুর কিওয়ে তার পিন দুরাবিল নামক একটি গ্রামে একযোগে বেশকিছু বাড়িতে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। কুতুপালংয়ে অবস্থান করা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে এই আগুন দেয়ার খবর জেনেছেন। কয়েকজন রোহিঙ্গা এক্টিভিস্টও এই ধরনের খবর দিয়েছেন। তারা আগুন দেয়ার ছবিও সরবরাহ করেছেন। ছবিগুলোতে দেখা গেছে, বেশকিছু বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে পুরো আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। এক্টিভিস্টরা বলছেন, পুরো গ্রামের সবক’টি বাড়িতেই আগুন দেয়া হয়েছে। তবে কেউ হতাহত হয়েছে কি-না তা জানা যায়নি। যদিও পুরো ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে যাচাই সম্ভব হয়নি।
৯ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার: টেকনাফের নাফ নদীর দুটি পয়েন্ট থেকে নারী-শিশুসহ আরো আট রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পয়েন্ট থেকে মাইন বিস্ফোরণে নিহত এক রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। টেকনাফের স্থানীয় চেয়ারম্যান শাহাজান মিয়া জানিয়েছেন, বুধবার সকালে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া নাফ নদীতে মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা। পরে দুই রোহিঙ্গা শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান, শাহপরীর দ্বীপের মাঝেরপাড়া থেকে ৩ শিশু ও ২ নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। অন্যদিকে ভোরে বাহারছড়া থেকেও একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় চেয়ারম্যান মাওলানা আজিজ উদ্দিন। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী জানান, মিয়ানমারের পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে নিহত রোহিঙ্গা যুবকের নাম মোক্তার আহমদ। তিনি মিয়ানমারের ফকিরাবাজার এলাকার আবদুস সালামের ছেলে।
চলছে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন: নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। গতকাল তৃতীয় দিনে এসে সর্বমোট আটশ’ রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য সেলের সদস্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম লুত্ফুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথম দিনের ১২ জন, দ্বিতীয় দিনের ১৫০ জন ও তৃতীয় দিনে ৬৩৮ জন মিলিয়ে তিন দিনে ৮শ’ রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে একটি মাত্র বুথেই কাজ করতে হচ্ছে। গতকাল দুপুরে নিবন্ধন কার্যক্রম পরিদর্শনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা খুব আগ্রহ নিয়ে লাইন ধরে ছবিসহ বায়োমেট্টিক রেজিস্ট্রেশন করছে।