সমাজে সচ্ছলতা শুধু দেশে-বিদেশে শ্রম বিকোনোর অর্থে আসেনি, চাষ আবাদে আধুনিকায়নসহ বহুক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণও সহায়ক হয়েছে। অথচ এই ক্ষুদ্র ঋণ অনেকেরই গলার কাঁটা হয়েছে, হয়েছে গলার ফাঁস। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের মোমিনপুর ইউনিয়নের সরিষাডাঙ্গা গ্রামের এক গৃহবধূ তার কোলের সন্তান রেখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পাড়া প্রতিবেশীরাই শুধু নন, পরিবারের সদস্যদের তরফেও বলা হয়েছে, ঋণের কিস্তির টাকা আদায়ে অপমানজনক উক্তি আওড়ানোর কারণে গৃহবধূ শিল্পী আত্মহত্যা করেছেন।
ক্ষুদ্র ঋণের সুদ প্রায় দাদন কারবারি মহাজনদের মতোই। দাদন দেয়া মহাজনদের শুধু চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে বাড়ির ভিটেও হাতিয়ে নেয়, আর বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সেই চক্রবৃদ্ধির বদলে চড়া সুদসহ আসল কিস্তি করে আদায় করে। কিস্তি আদায়ের ধরণ সেই কাবলি তাগাদাকেও হার মানায়। কেনো? কড়া ভাষায় কিস্তি আদায় না করলে নাকি ঋণগ্রহীতা কিস্তির টাকা দিতে তেমন আগ্রহী হন না। এ মন্তব্যের পক্ষে বিপক্ষেই শুধু যক্তির ফুলঝুড়ি নয়, ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। তবে একজন ঋণগ্রহিতা কখন আত্মহত্যা করেন তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে নিশ্চয়। ঋণের কিস্তি আদায়কারীর উপস্থিতিতেই একজন ঋণগৃহিতা নারী আত্মহত্যা করলেন অথচ কিস্তি আদায়কারী তখনও বুঝলেন না? সরিষাডাঙ্গার গৃহবধূ শিল্পী খাতুন তাদের বাড়িতে পালন করা গরু বিক্রি করে বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থার নিকট থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রত্যাশিত মূল্যে গরু বিক্রি না হওয়ার কারণেই নাকি ঋণের কিস্তি দেয়া দূরাস্ত সংসারেও টানাটানি দেখা দেয়। এতে বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, শিল্পী খাতুনের আত্মমর্যাদা কতোটা উঁচুতে। সেই মর্যাদায় আঘাত দেয়ার আগে যে কিস্তি আদায়কারী বা ঋণ দাতা সংস্থার আঞ্চলিক কর্তা বুঝতে পারেন না তার দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গতই শুধু নয়, অবশ্যই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। তদন্ত এই কারণে হওয়া দরকার যে, ঘটনার আড়ালে কেউ কলকাঠিও তো নাড়তে পারেন। কেননা, যে গরু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের কথা, সেই গরু যথাসময়ে কেন বিক্রি করা হলো না? খতিয়ে দেখার দাবি অযৌক্তিক নয়। এক দিকে ঋণের কিস্তির জন্য অপদস্থ, অপরদিকে চড়া দাম পাওয়া যাচ্ছে না বলে গরু বিক্রি করতে দিচ্ছেন না কর্তা। ঘটনার আড়ালে এরকম কিছু নেই তো? প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন অবশ্যই সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
সমাজে আত্মহত্যা প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আত্মহত্যার জন্য প্রবণতাও কম দায়ী নয়। এ প্রবণতা রোধের দায় সমাজ এড়াতে পারে না। সমাজের স্বার্থেই রুখতে হবে ওই প্রবণতা নামক ‘আগুনের ফুলকি’। আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ উন্মোচন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে যতো বিলম্ব হবে ততোই ক্ষতি। ক্ষুদ্র ঋণ যখন সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় বলেও দাবি করা হয় তাহলে আত্মহুতি কেন? কোন অজুহাতে বা ‘হাজারে একটা’ বলে দায় এড়ানো মানে সমাজের আসল চিত্র অস্বীকার করা।