মেহেরপুরে আউস ধানের ফলন ও দামে কৃষকের স্বস্তি

মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুরে চলতি মরসুমে আউস ধান আবাদে কাক্সিক্ষত ফলন পাচ্ছেন চাষিরা। অপরদিকে কাঁচা ধান বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৭০০ টাকা দরে। ফলে কৃষকের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। পাট চাষে লোকসান হওয়ায় আউস ধান আবাদের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মরসুমে জেলার ৩ উপজেলায় ১৫ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আউস ধান আবাদ হয়েছে। যা গত বছর আবাদের পরিমাণ ছিলো ৯ হাজার ৩০০ হেক্টর। বোরো ও আমন ধান চাষের চেয়ে আউসের খরচ তুলনামূলক কম। অন্যদিকে ভাদ্র মাসে গো-খাদ্যের সঙ্কট পূরণ হচ্ছে আউস ধানের খড়-বিচুলিতে। বোরো ও আমন মরসুমের মাঝামাঝি আউস ধান পেয়ে কৃষি পরিবারের ভাতের জোগানও হচ্ছে। এসব বিবেচনায় আউস আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। এ মরসুমের আবাদকৃত ধানের মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ কর্তন সম্পন্ন হয়েছে। যার গড় ফলন বিঘা প্রতি ১৮ থেকে ২৪ মণ পর্যন্ত। বিভিন্ন মাঠে হাইব্রিড, নেরিকা মিউটেন্ট ও ব্রি ধান ৪৮ আবাদ হয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগই ব্রি ধান ৪৮।
ভোমরদহ-জোড়পুকুরিয়া মাঠে ভোমরদহ গ্রামের কৃষক হাসান আলী গত সপ্তায় ধান কর্তন করেন। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, স্যালো ইঞ্জিনের সঙ্গে থ্রেসার দিয়ে ধান মাড়াই কাজে ব্যস্ত কয়েকজন চাষি ও গরু পালনকারী কৃষক।
কৃষক হাসান আলী বলেন, বোরো ও আমন মরসুমে উৎপাদিত ধানের চাউল থেকে পরিবারের ভাতের জোগান হয়। চাষের খরচের প্রয়োজনে ধান বিক্রি করতে হয়। এতে প্রতি বছরের শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত আমার ঘরে অভাব থাকে। তবে ভাদ্র মাসে আউস ধান উত্তোলনের ফলে অভাব দুর হচ্ছে।
অপরদিকে ভরা বর্ষা মরসুম তাই গো-খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মাঠেঘাটে ঘাসের আকাল। তাই কয়েকজন গরু পালনকারী আমার ক্ষেতের ধান কেটে মাড়াই করে দিয়েছেন। বিনিময়ে তারা ধানের বিচুলি নিয়েছে। এতে ধান কাটা ও মাড়াই খরচ বাবদ প্রায় ৪ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তবে অনেক কৃষক ধানের বিচুলি তৈরি করেও বিক্রি করছেন। ভোমরদহ গ্রামের কৃষক আনছার আলী ওই মাঠে দুই বিঘা জমিতে ব্রি ধান-৪৮ আবাদ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিঘা প্রতি প্রায় ২২ মণ ফলন হয়েছে। কাঁচা অবস্থায় প্রতি মণ ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। বোরো ও আমন ধানের চেয়ে আউস ধান আবাদের খরচ তুলনামূলক কম। বিঘা প্রতি সর্বোচ্চ খরচ সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বর্তমান বাজার দরে বিক্রি করে বিঘা প্রতি প্রায় ৮ হাজার টাকা লাভ পেলাম। ধান মাড়াই করার পর চাতাল মালিকরা কাঁচা অবস্থায় ওজন করে কিনে নিয়েছেন। ফলে ধান শুকানো ও পরিবহন খরচ সাশ্রয় হয়েছে।
ধর্মচাকী গ্রামের পাট চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, আউস ধানের মরসুম ও পাটের মরসুম একই। দুই বিঘা পাট চাষ করে আমার প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। যারা আউস ধান আবাদ করেছেন তারা লাভবান হয়েছে। আগামী মরসুমে পাট আবাদ না করে আউস ধান আবাদ করার চিন্তা করছি।
চাষি ও কৃষি অফিসসূত্রে আরো জানা গেছে, বোরো, আমন ও রবি মরসুমে মেহেরপুর জেলায় ফসলে ফসলে মাঠ ভরে যায়। রবি মরসুমে গম, মসূর ও ডাল-তেল জাতিয় ফসলের বীজ বপণ শুরু হয় কার্তিক মাস থেকে। আউস ধান কর্তনের পর দেড় মাস জমি পড়ে থাকে। চাষ করে জমি ফেলে রাখার ফলে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। আমন ধান কর্তনের পর রবি ফসল চাষ করতে গেলে নাবলা হয়ে যায়। কিন্তু আগোড়ি রবি ফসল বপণ করা গেলে পরবর্তী ফসল আবাদ করা যায় সহজেই। রবি ফসল তোলার পর মুগ ডাউল আবাদ করে আবারো আউস ধান এবং আউস ধান কেটে রবি মরসুম ধরা যায়।
অপরদিকে আউস ধান কর্তনের পর মাস কালাই আবাদ করেও রবি ফসলে যাওয়া যায়। এভাবে হিসেব করে অনেক চাষি একই জমিতে বছরে ৩ থেকে ৪টি ফসল উৎপাদন করছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সিটিউট (ব্রি) উদ্ধাবিত ব্রি ধান ৪৮। জাতীয় বীজবোর্ড ২০০৮ সালে রোপা আউস হিসেবে জাতটি অবমুক্ত করে। জাতের বৈশিষ্ট্য অধিক ফলন, চাল মাঝারি মোটা, ভাত ঝরঝরে ও সু-স্বাদু। ফলে আর্থিক ও খাদ্য জোগানের ক্ষেত্রে ব্রি-ধান ৪৮ সকলের নজর কেড়েছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকের কাছে আস্থা অর্জন করেছে ব্রি ধান ৪৮। হাইব্রিড ও নেরিকা মিউটেন্ট জাতের ধান আবাদ হলেও তা পরিমাণে কম। আউস ধান আবাদে খাদ্য চাহিদা পুরণ ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার আউস ধান আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

Leave a comment