নৃশংসতার চিহ্ন মুছতে গুম করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের লাশ

স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের নৃশংসতার চিত্র? মুছে ফেলতে নিহত রোহিঙ্গাদের লাশ গুম করছে। তারা আগুনে পুড়িয়ে, মাটিতে পুঁতে ও নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিথর দেহ গুম করছে, যাতে পরবর্তীতে বিশ্বের কেউ এসে এর প্রমাণ না পায়। উখিয়ায় অনুপ্রবেশকারী অনেক রোহিঙ্গা এই দাবি করেছেন। এদিকে, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এক মাসের জন্য অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির নো ম্যানস ল্যান্ডের কাছে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে তিন রোহিঙ্গা।

মিয়ানমার চলমান সেনা অভিযানে চার শতাধিক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে সেদেশের সরকার। তবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য গঠিত সর্বদলীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও লেবার পার্টির এমপি রুশনারা আলীর নেতৃত্বে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্যদের লিখিত এক চিঠিতে নির্ভরযোগ্য রোহিঙ্গা সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। লন্ডনে বসবাসরত মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা এক্টিভিস্ট ড. মং জার্নিও এর আগে ইত্তেফাকের কাছে এই দাবি করেছিলেন।

যদিও অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা মৃতের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে দাবি করেছেন। তারা বলছে, মিয়ানমারের সৈন্যরা নৃশংসতার চিত্র মুছে ফেলছে। তারা রোহিঙ্গাদের গুলি করে হত্যার পর লাশ এক জায়গায় জড়ো করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে। অনেক বাড়িতে গিয়ে সবাইকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে  দিয়ে আগুন দিচ্ছে। ফলে সবাই ঘরের ভেতরে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অনেককে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ধরে নিয়ে জ্যান্ত আগুন দিয়ে মারছে। অনেক গ্রামে বড় গর্ত করে গণহারে পুঁতে পেলা হচ্ছে। যারা বিজিপির হাতে খুন হচ্ছে তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে নদী ও স্থলভাগে অনেক লাশ উদ্ধারও হয়েছে।

রাথিডং এলাকা থেকে মা, স্ত্রী, তিন সন্তান ও আরো দুইভাইকে নিয়ে কুতুপালং এসেছেন কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ৩০ তারিখের আগে অনেক এলাকায় লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। লাশের পরিচয় চিনতে পেরে কেউ কেউ স্বজনদের দাফন করেছেন। একই দাবি করেছেন বুচিদং থেকে আসা আব্দুর রব। তিনি বলছিলেন, গত ৩১ আগস্ট তার ভাই আব্দুর মতিন, চাচাতো ভাই খশরু মিয়াজীকে ধরে নিয়ে গেলেও তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওদের সাথে গ্রামের আরো কয়েকজনকেও ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে হত্যা করা হয়। শুনেছি সবার লাশ একসাথে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা এক্টিভিস্ট রো ন্যা সান লুইন মংডুর এক রোহিঙ্গা থেকে একটি ভিডিও সংগ্রহ করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে বেশ কয়েকটি লাশ বস্তায় ভরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। স্বজনরা মাটি খুঁড়ে বস্তাগুলো দেখতে পেয়েছেন। সান লুইন বলেছেন, অনেক এলাকায় সৈন্যরা বেসামরিক লোকদের হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলছে। অনেকেই তাদের স্বজনদের লাশ খুঁজে পাচ্ছেন না। এসবের সাথে স্থানীয় রাখাইন যুবকরা জড়িত। রোহিঙ্গাদের একটি অনলাইন টিভি, একটি নিউজ নেটওয়ার্কেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্রিটেনের ১৭৫ জন এমপি সেদেশের পররাষ্ট্রমনন্ত্রী বরিস জনসনকে যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে তারা মিয়ানমার সৈন্যদের এমন নৃশংসতা ও নিপীড়ন বন্ধে উদ্যোগ নিতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

সামনে দাঁড়ালেই গুলি: মোহাম্মদ খলিল এসেছে বড় গজির বিল এলাকা থেকে। ওই এলাকায় গত অক্টোবরে অসংখ্য মানুষকে হত্যার পর গ্রামের অনেক এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়েছে। অল্প কিছু পরিবার আছে তাদের ঘরও পুড়িয়ে দিচ্ছে সৈন্যরা। কেউ ঘর না পোড়াতে আকুতি জানালে তাকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে গুলি করে, কুপিয়ে হত্যা করছে। খলিল বলছিলেন, তার পাশের বাড়িতে মজনু মিয়া নামের এক কৃষক থাকতেন। সৈন্যরা তাদের কুঁড়ে ঘরে আগুন দিতে গেলে মজনু সৈন্যদের পায়ে পড়েন। এসময় এক সৈন্য তাকে লাথি মেরে দূরে ঠেলে দিলে দুই রাখাইন যুবক তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে ওই কৃষকের স্ত্রী, চার সন্তানকে তার (খলিল) পরিবারের সাথে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। আবার অনেক এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে রাতের বেলা ঘরে থাকতে অভয় দিচ্ছে। কিন্তু রাতের বেলায় ওইসব এলাকাতেই আগুন দেয়া হচ্ছে। প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা এখন আর ঘরে অবস্থান করছে না। এখনো পর্যন্ত সেখানে নৃশংসতা চলছে বলে জানাচ্ছেন সদ্য অনুপ্রবেশকারীরা।

১২ তারিখের মধ্যে আরাকান ছাড়ার নির্দেশ: সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানাচ্ছেন, সেখানে গত কয়েকদিন ধরে মাইকিং করে আগামী কালের মধ্যে (মঙ্গলবার) রোহিঙ্গাদের আরাকান রাজ্য ছাড়তে বলা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে মিয়ানমার না ছাড়লে কাউকে সেখানে প্রাণে বাঁচতে সাহায্য করা হবে না বলে জানানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে- মাইকে বলা হচ্ছে ‘মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশ নয়। রোহিঙ্গারা সবাই বাঙালি। ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তোমরা (রোহিঙ্গারা) আরাকান ছেড়ে চলে যাও’ বৃদ্ধ বাবা-মাকে কাঁধে নিয়ে ৩৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি : মোহাম্মদ নেজাম এসেছেন দক্ষিণ মংডু থেকে। তার কাঁধের দুই পাশে দুটি ঝুড়ি। এক ঝুড়িতে বাবা, অন্যটিতে মা। বাবা মোহাম্মদ ফকিরের বয়স ৯৬, মা জমিলা খাতুনের বয়স ৮৭। দুজনের কেউই হাঁটতে পারেন না। অনুপায় হয়ে সন্তান বাবা মাকে ঝুপড়িতে করে অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছেন। অবশেষে পাঁচদিন পর বাংলাদেশের কুতুপালংয়ে পৌঁছেন তিনি।

আরসার অস্ত্রবিরতি: গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার জন্য দায়ী করা সংগঠন আরসা এক মাসের জন্য সাময়িক অস্ত্রবিরতি ঘোষণা  করেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে আরসার বিবৃতি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, রাখাইনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে অস্ত্র বিরতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও এখনো পর্যন্ত এই ব্যাপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

নতুন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ শুরু: প্রাণে বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উখিয়ার বালুখালীতে আড়াই হাজার একর জায়গা জুড়ে নতুন করে আরেকটি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানিয়েছেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে জরুরি ভিত্তিতে গতকাল রোববার এটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এটি হবে সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্র। সেখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস উপযোগী সব ব্যবস্থা থাকবে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে সেখানে নেয়া হবে।

সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে নিহত ৩: লামা (বান্দরবান) সংবাদদাতা জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন রেজু, আমতলী ও তুমরু সীমান্তে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীদের পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গা নিহত ও আরো তিন জন আহত হয়েছে। শনিবার রাত ও রোববার সকালে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহতদের লাশ জিরো পয়েন্টের নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে আছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-মিয়ানমার নো ম্যানস ল্যান্ডের কয়েকশ গজের মধ্যে নতুন করে স্থল মাইন পুঁতেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে গুলিবিদ্ধ আরো রোহিঙ্গা: চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে গুলিবিদ্ধ আরো ৯ রোহিঙ্গা নাগরিক ভর্তি হয়েছে। শনিবার গভীর রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছে। আবার অনেক এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে রাতের বেলা ঘরে থাকতে অভয় দিচ্ছে। কিন্তু রাতের বেলায় ওইসব এলাকাতেই আগুন দেওয়া হচ্ছে। প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা এখন আর ঘরে অবস্থান করছে না। এখনো পর্যন্ত সেখানে নৃশংসতা চলছে বলে জানাচ্ছেন সদ্য অনুপ্রবেশকারীরা।

বাঁশখালীতেও আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা: বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১৮ জন রোহিঙ্গা বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের বাণীগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় মৌলভী তৌহিদ বৈদ্যের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে স্থানীয় জনগণ নানাভাবে সহযোগিতা করছে। এ খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মো. চাহেল তস্তরী, সাধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী খোকা, ওসি আলমগীর হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা সেখানে যান। এদিকে সাধনপুর ছাড়াও পুঁইছড়ির পূর্ব পুঁইছড়ি সাইর পাড়া, নাপোড়া পাহাড়ি এলাকা, পূর্ব চাম্বল পাহাড়ি এলাকা, জঙ্গল জলদী আদর্শ গ্রামসহ গুনাগরী, বাণীগ্রাম ও বাঁশখালী-সাতকানিয়া সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা আগে থেকেই অবস্থান করছে বলে অনেকে দাবি করেছেন।