সুচি প্রসঙ্গ

সুচির দাবি রাখাইনে সবাই নিরাপদে

মাথাভাঙ্গা মনিটর: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সবার নিরাপত্তাবিধান করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন দেশটির নেত্রী অং সান সুচি। রাখাইনে সপ্তাহ দুয়েক আগে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সবশেষ নৃশংস অভিযান শুরুর পর এই প্রথম এ বিষয়ে মুখ খুলে এমন দাবি করলেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা।

গতকাল বুধবার বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে গতকাল মঙ্গলবারের ফোনালাপে সুচি ওই দাবি করেন। দুই নেতার ফোনালাপের বিষয়ে সুচির দপ্তর থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, এরদোয়ানকে সু চি বলেছেন, তার সরকার ইতোমধ্যে যথাসাধ্য উপায়ে রাখাইনের সব মানুষকে সুরক্ষা দিতে শুরু করেছে। সুচি বলেছেন, মানবাধিকার-বঞ্চনা ও গণতান্ত্রিক সুরক্ষার অর্থ তারা খুব ভালো করেই জানেন। তাই তারা দেশের সব মানুষের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করছেন। এটা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও মানবিক অধিকারও বটে। সুচির দাবি, রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে প্রচুর অপ-তথ্য ছড়াচ্ছে। এই অপ-তথ্য সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রীর টুইটারে পোস্ট করা হত্যাযজ্ঞের ছবির প্রসঙ্গ টেনে সুচি দাবি করেন, ওই ছবি মিয়ানমারের নয়। পরে অবশ্য ছবিগুলো সরিয়ে নিয়েছেন তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী।

মিয়ানমার সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রচুর ভুয়া ছবি ছড়াচ্ছে। এতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশে এসব অপ-তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে অপ-তথ্য ছড়ানোর জন্য সন্ত্রাসীদের দায়ী করেন সুচি।

সহিংসতার মুখে লাখো রোহিঙ্গার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার বিষয়ে সুচি কোনো মন্তব্য করেননি। গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে বেশ কয়েকটি তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-নির্যাতন শুরু হয়। নির্বিচারে হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ায় প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে।

এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে কতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও সংখ্যাটি ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার বলছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জেনেভায় গতকাল এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, গত মাস থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির নীরব ভূমিকার নিন্দায় সরব হয়েছে বিশ্ব। দেশে দেশে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ থেকে শান্তিতে এই নোবেলজয়ীর পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দাবি তোলা হয়েছে।

 

সুচির নোবেল পদক কেড়ে নেয়ার সুযোগ কতটুকু

মাথাভাঙ্গা মনিটর: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পদক পেয়েছিলেন মিয়ানমারের ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেতা (এনএলডি) এবং বতর্মানে জান্তা সরকারের বিশেষ উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সুচি। দীর্ঘ কারাবাস শেষে তিনি এখন মুক্ত। তিনি বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। অথচ তার সামনেই দেশটির রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালাচ্ছে নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ। মিয়ানমার সরকারের এ নির্যাতন-নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু হওয়া অভিযানে সম্প্রতি ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছে। সাগরে ও নদীতে ভাসছে রোহিঙ্গা শিশুদের লাশ। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে হাজার হাজার বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সুচি কিছু বলছেন না। এ ব্যাপারে সুচির কোনো উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেই। এমন অবস্থায় সুচির নোবেল পুরস্কারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন সুচির নোবেল ফিরিয়ে নেয়া হবে না এমন প্রশ্নও উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্ষোভকারীরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের পাশাপাশি সুচির নোবেল ফিরিয়ে নেয়ার দাবিও জানাচ্ছেন।

সুচির পদক কেড়ে নেয়া হবে কি-না এ নিয়েও তর্ক হচ্ছে। আদৌ কেড়ে কি নেয়া হবে? কেড়ে নেয়া কি সম্ভব? এমন সব প্রশ্ন নিয়েই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বিক্ষোভকারীরা সুচির পদক কেড়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। জাকার্তায় বিক্ষোভকারীদের একজন ফরিদা বলেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চলার সময় সারাবিশ্ব নীরব ভূমিকায় আছে।’ রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে সুচির নীরবতা নিয়ে অন্য নোবেলজয়ীরাও সমালোচনা করেছেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সুচির ভূমিকার সমালোচনা করেন। এক টুইটার বার্তায় মালালা লিখেছেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমি এই মর্মান্তিক ও লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আসছি। আমি এখনও অপেক্ষা করছি নোবেলজয়ী সুচি একই কাজ করবেন। সারাবিশ্ব অপেক্ষা করছে এবং রোহিঙ্গা মুসলমানরাও অপেক্ষা করছে।
১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন সুচি। কিন্তু সামরিক জান্তা তা মেনে নেয়নি। এরপরই কারাবন্দি হতে হয় সুচিকে। ১৫ বছর টানা বন্দিজীবন কাটান তিনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবরই নীরব ছিলেন সুচি। এ ব্যাপারে সামরিক জান্তার সঙ্গেই হেঁটেছেন তিনি। জান্তা সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনিও বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা অবৈধ। ২০১৩ সালের এ বিষয়ে এক বিরল সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর এটা কোনো ‘জাতিগত নিধন’ নয়। নোবেল নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়া সুচিই প্রথম কোনো ব্যক্তি নন। এর আগে মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নোবেল পদক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো। ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের নেতা শিমন পেরেস ও আইজ্যাক রবিনের সঙ্গে নোবেল পেয়েছিলেন ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত। তবে নোবেল কমিটিতে থাকাকালে ক্রিস্টিয়ানসন নামে এক সদস্য তা মেনে নিতে পারেননি। তার দৃষ্টিতে ইয়াসির আরাফাত ছিলেন একজন ‘সন্ত্রাসী’।

১৯৯১ সালে সুচিকে নোবেল দেয়ার সময় নোবেল কমিটিতে ছিলেন নরওয়ের রাজনীতিক গুনার স্টলসেট। তিনি বলেন, ‘নোবেল কমিটি প্রদত্ত পুরস্কার কখনও ফেরত নেয় না। সুচির ক্ষেত্রেও সেটা করা হবে না। তিনি বলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার কখনই ফেরত নেয়া হয় না এবং কমিটি নোবেলজয়ীদের প্রতি কোনো নিন্দাজ্ঞাপনও করে না।’ স্টলসেট আরও বলেন, ‘আমরা যে নীতি অনুসরণ করি সেটা শুধু সিদ্ধান্তের অনুসরণ। আর এই নীতি কোনো সাধুর ঘোষণা নয়।’ তিনি বলেন, পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই নোবেল কমিটির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির নিন্দায় সরব বিশ্ব




এদিকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচি এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ওপর সম্প্রতি শুরু হওয়া নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খোলেননি। প্রসঙ্গত, পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সুচি ছিলেন একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। তাকে এমন একটি স্থানে অধিষ্ঠিত করা হয়, যেখানে খুব কম মানুষই ঠাঁই পান।

মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি এ সপ্তাহের শুরুর দিকে বলেন, হাজারো রোহিঙ্গা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছেন। গত সোমবার ভারতের গণমাধ্যমে ইয়াংঘিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি ‘সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ’। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে এক মুখপাত্র তা জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নির্যাতন-নিপীড়নকে ‘গণহত্যা’র সাথে তুলনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি বলেন, চলতি মাসের শেষে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এই ইস্যুটি তিনি তুলবেন। সোমবার মালদ্বীপ মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানায়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংসতার প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক টুইট বার্তায় বলেন, মিয়ানমারের জাতিগত নির্মূল অভিযান বন্ধ করতে চাইলে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এর আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে সোমবার রাশিয়ার চেচনিয়াতেও হয় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ।